
ছবি: সংগৃহীত।
ছোটবেলায় আমরা অনেকেই কল্পনা করতাম—যদি পৃথিবীর মাটিতে একটানা গর্ত খোঁড়া যায়, তবে কি একসময় আমরা পৃথিবীর বিপরীত প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারি? এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা শুরু করেছিলেন এক অনন্য বৈজ্ঞানিক অভিযান, যার লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর অভ্যন্তরীন গঠন সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার চেষ্টা।
কোলা সুপারডিপ বোরহোল: ইতিহাসের সূচনা
১৯৭০ সালের ২৪ মে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা উত্তর-পশ্চিম রাশিয়ার কোলা উপদ্বীপে শুরু করেন বিশ্বের সবচেয়ে গভীর খনন প্রকল্প। এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় "কোলা সুপারডিপ বোরহোল"। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল যতটা সম্ভব গভীরে পৌঁছানো এবং ভূগর্ভের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ১৯৮৯ সালে পৌঁছান ১২,২৬২ মিটার, অর্থাৎ প্রায় ১২.৩ কিলোমিটার গভীরে—যা এখন পর্যন্ত মানুষের তৈরি সবচেয়ে গভীর গর্ত হিসেবে স্বীকৃত। তবে এই অভিযানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা। গভীরে পৌঁছানোর পর বিজ্ঞানীরা সম্মুখীন হন প্রায় ২২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার, যা তাদের ড্রিল বিটকে গলিয়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট ছিল। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন এবং আর্থিক সমস্যার কারণে ১৯৯২ সালে প্রকল্পটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, এবং ২০০৮ সালে গর্তটি সম্পূর্ণ সিলগালা করে দেওয়া হয়।
যদিও কোলা বোরহোল পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেনি, তবে এটিকে ব্যর্থতা বলা ভুল হবে। বরং এই প্রকল্প উন্মোচন করেছে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক তথ্য। বিজ্ঞানীরা সেখানে খুঁজে পান প্রায় দুই বিলিয়ন বছর ধরে উচ্চ তাপ ও চাপে টিকে থাকা জীবাণু। এছাড়াও তারা ভূগর্ভে পানি ও স্বর্ণের অস্তিত্ব শনাক্ত করেন, যদিও এত গভীর থেকে এগুলোর উত্তোলন প্রায় অসম্ভব।
এছাড়াও আবিষ্কৃত হয় ঘন মিথেন গ্যাস, এবং পাথরের গঠনে এমন বৈশিষ্ট্য যা পূর্বের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এসব তথ্য পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করেছে।
‘ওয়েল টু হেল’: রহস্যময় গুজব
এই গর্ত ঘিরে ছড়ায় একটি রহস্যময় ও ভৌতিক গুজব, যা পরিচিত ‘ওয়েল টু হেল’ নামে। অনেকেই দাবি করেন, গর্তে মাইক্রোফোন নামিয়ে শোনা গেছে নরকের আর্তচিৎকার। তবে বিজ্ঞানীরা এই দাবি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তারা জানিয়েছেন, প্রকল্পে কোনো মাইক্রোফোন ব্যবহার করা হয়নি, এবং যান্ত্রিক শব্দ বা গুজব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
বিশ্বজ্ঞানকে নাড়া দেওয়া অনুসন্ধান
পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৬,৩৭০ কিলোমিটার। অথচ কোলা বোরহোল পৌঁছাতে পেরেছে মাত্র ০.২ শতাংশ পথ—এ যেন বিশাল সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে বালু হাতে নেওয়ার মতোই।
তবুও, এই অনুসন্ধান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—নিজেদের গ্রহ সম্পর্কেও আমরা কত অল্প জানি। কোলা সুপারডিপ বোরহোল প্রকল্প থেমে গেলেও রেখে গেছে অমূল্য বৈজ্ঞানিক তথ্য, আর প্রমাণ করে দিয়েছে—মানবজ্ঞান সীমাহীন হলেও, পৃথিবীর গহ্বর এখনও রহস্যে মোড়া।
সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=7y8AJ10d85M
সায়মা ইসলাম