
ছবি: সংগৃহীত
একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। যন্ত্র নিজে চিন্তা করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে—এমন এক সময়ে আমরা পা রেখেছি। এটি যেমন মানুষের জীবনকে সহজ, দ্রুত ও কার্যকর করে তুলছে, তেমনি এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে নতুন ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমনকি অস্তিত্বগত হুমকি।
প্রশ্ন উঠছে—এই প্রযুক্তি কি মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ, না কি এক ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যতের সংকেত?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, নিরাপত্তা ও সৃজনশীল শিল্পে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্য খাতে AI ব্যবহার করে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরিকল্পনা এবং রোগীর পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ক্যানসার, স্নায়ু রোগ, এমনকি মানসিক সমস্যাও এখন AI বিশ্লেষণ করে চিহ্নিত করতে পারছে। কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি দিয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, কীটনাশক ব্যবস্থাপনা এবং ফলনের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষা খাতে AI-ভিত্তিক পাঠ্য সহকারী ও অনলাইন অনুবাদক ব্যবস্থায় শিক্ষাগ্রহণ আরও সহজ হয়েছে।
অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে, AI-চালিত অটোমেশন প্রযুক্তি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মানব শ্রমের পরিবর্তে মেশিন ব্যবহার করে খরচ কমাচ্ছে, সময় বাঁচাচ্ছে। তবে এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পেছনে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে একটি ভয়াবহ বাস্তবতা—তা হলো চাকরি হারানোর আশঙ্কা।
গবেষণা সংস্থা ম্যাকিন্সির তথ্যানুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বিশ্বজুড়ে ৮০ কোটির বেশি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। বিশেষ করে পুনরাবৃত্তিমূলক ও ম্যানুয়াল কাজগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশে এর প্রভাব গার্মেন্টস, কল সেন্টার, ট্রান্সপোর্ট ও ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক হতে পারে।
তবে শুধু কর্মসংস্থান নয়, AI-এর ফলে তথ্যপ্রবাহ, সমাজ ও নৈতিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে Deepfake প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি ভিডিও ও ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছে। ২০২৩ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলাকালে একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিচ্ছেন, যা ছিল সম্পূর্ণ Deepfake।
এছাড়া, AI-ভিত্তিক নজরদারি প্রযুক্তি, যেমন facial recognition, বিভিন্ন দেশে জাতিগত বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের মুখভিত্তিক ভুল গ্রেফতার ঘটেছে। একই সঙ্গে AI প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে সেনা অস্ত্র, ড্রোন ও স্বয়ংক্রিয় রোবট নির্মাণে, যেগুলো মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। লিবিয়ায় ২০২০ সালে এমনই এক AI-নিয়ন্ত্রিত ড্রোন (Kargu-2) মানব টার্গেটে আক্রমণ করে বলে জাতিসংঘের রিপোর্টে জানানো হয়।
তথ্যপ্রযুক্তির এই বিপ্লব শুধু সমাজ ও রাজনীতি নয়, শিল্প-সাহিত্যেও ঢেউ তুলেছে। MidJourney ও DALL·E-এর মতো AI আর্ট জেনারেটরগুলো বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের ছবি বিশ্লেষণ করে নতুন ছবি তৈরি করছে। ফলে বহু চিত্রশিল্পী অভিযোগ তুলেছেন, তাদের কাজ চুরি হচ্ছে এবং কৃতিত্ববিহীনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
AI ব্যবহারে আরেকটি ভয়াবহ দিক উঠে এসেছে ২০১৭ সালে, যখন ফেসবুকের দুটি AI বট নিজেদের মধ্যে এমন ভাষায় কথা বলা শুরু করে যা মানুষের কাছে অস্পষ্ট ও অজানা ছিল। এই ঘটনায় বটগুলোকে বন্ধ করে দিতে হয়। প্রশ্ন উঠেছে—যদি AI এক সময় মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চিন্তা করতে শেখে, তবে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার গ্যারান্টি কোথায়?
এই সব উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে সরকার ও প্রযুক্তি সংস্থাগুলো AI নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন 'EU AI Act' পাস করেছে, যা উচ্চ ঝুঁকির AI সিস্টেমের ব্যবহারে কঠোর নিয়ম আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীনসহ বহু দেশ AI নীতিমালা প্রণয়ন করছে। জাতিসংঘও 'AI for Good' কর্মসূচির মাধ্যমে নীতিগত দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বারবার সতর্ক করে বলেছেন—AI যদি মানবিক নীতির বাইরে চলে যায়, তবে তা মানবজাতির ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। টেসলা ও স্পেসএক্স প্রধান এলন মাস্ক একে ‘মানবতার সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনো পর্যন্ত AI প্রযুক্তি সীমিতভাবে ব্যবহৃত হলেও, দ্রুতগতিতে এ খাতে প্রবেশ বাড়ছে। ব্যাংকিং, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে AI-এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এখনই প্রয়োজন দেশের জন্য একটি সুস্পষ্ট এআই নীতিমালা, যার মাধ্যমে প্রযুক্তিকে মানব কল্যাণে কাজে লাগানো সম্ভব হবে এবং হুমকিগুলো প্রতিরোধ করা যাবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি একদিকে যেমন ভবিষ্যতের আলোর পথ, অন্যদিকে এটি এক বিপজ্জনক ছায়াও। এই প্রযুক্তির ব্যবহার কতটা আশীর্বাদ আর কতটা অভিশাপ হবে তা নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতির ওপর। মানুষ যদি এই প্রযুক্তির নৈতিক ও সামাজিক দিক বিবেচনায় রেখে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, তাহলে এটি হবে আগামী প্রজন্মের জন্য এক বিশাল অর্জন। আর যদি অবহেলা করা হয়, তবে একদিন হয়তো মানুষের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হবে তার নিজেরই তৈরি মেশিন।
Mily