.
বাংলাদেশের আইটি খাতে এখন সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ দুটিই রয়েছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে বিগত সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, তার প্রেক্ষিতে দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, এবং আইটি কাঠামোর ওপরও নেমে এসেছে বিপর্যয়।
সাম্প্রতিককালে সামাজিক ও গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এসব বিষয়। অতীত সরকারের সময়ে আইটি খাতের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা ব্যাপকভাবে অবহেলিত হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশের আইটি খাত বেশ কিছু দেশের পিছনে চলে গেছে।
বর্তমান সরকারের নীতিমালা ও উদ্যোগের মাধ্যমে এই খাত পুনর্গঠন এবং আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা সুস্পষ্ট। অতীতের দুর্নীতির কারণে আইটি খাতের মূল কাঠামো যেমন প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, সাইবার নিরাপত্তা, এবং ডেটা সুরক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইটি খাতের কর্মীদের দক্ষতা ও অবদান ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের রেমিট্যান্সে ভূমিকা রাখার সুযোগও ছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।
নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে কিছু নতুন সুযোগও তৈরি হয়েছে। প্রথমত, নতুন প্রযুক্তি ও সফটওয়্যারের উন্নয়ন এবং ব্যবহারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা জরুরি।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম উন্নত করার মাধ্যমে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যেতে পারে। দেশের সব সরকারি অফিসগুলোকে ১০০% তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এবং ডিজিটালাইজ করা উচিত, এবং কোণ সরকারি কাজ ডিজিটালাইজেশন এর বাইরে করা যাবে না। সাইবার নিরাপত্তা এবং ডেটা সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ডিজিটাল সম্পদকে সুরক্ষিত রাখার জন্য শক্তিশালী সাইবার সিকিউরিটি নীতিমালা ও কৌশল গ্রহণ করা দরকার । এ ধরনের উদ্যোগ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট যেমন পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ও ড্রাইভিং লাইসেন্স সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক হবে।
দেশীয় কোম্পানির সক্ষমতা
এতদিন প্রচলিত ধারণা ছিল যে, বাংলাদেশের স্থানীয় কোম্পানিগুলো ব্যাংকিং, শেয়ার মার্কেট, সিকিউরিটি সফটওয়্যার, ঊজচ সফটওয়্যার, ও সরকারের ডাটা সেন্টারের কাজ করতে সক্ষম নয়। কিন্তু এটি একান্তই ভুল ধারণা ছিল। দেশের অনেক কোম্পানি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, যারা সরকারি ও প্রাইভেট সেক্টরের আইটি সার্ভিস এবং সাপোর্ট প্রদান করতে সক্ষম।
আইটি খাতে পিছিয়ে পড়ার কারণ
তথ্য উপদেষ্টার তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আইসিটি ও টেলিযোগাযোগ খাতে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং ও প্রযুক্তিগত সেবায় এশিয়ার অনেক দেশ থেকে পিছিয়ে রয়েছে।
এই পিছিয়ে পড়ার মূল কারণগুলির মধ্যে অর্থের অপব্যবহার ও প্রকল্পের অর্থায়নে দুর্নীতি অন্যতম। বিগত সময়ে, যেসব কোম্পানি সরকারি কাজ পেত, তারা সাধারণত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, কমিটির সভাপতি, পিডি ও ক্ষমতাশীল মহলকে সন্তুষ্ট করে কাজ পেত। অনেক সময় দেখা যায়, এসব কোম্পানির কোনো সুনাম বা অভিজ্ঞতা নেই; তাদের অফিস হয় মাত্র এক কক্ষের বা শুধু ট্রেড লাইসেন্সধারী। সরকারি প্রকল্পগুলোর কমিশন বাণিজ্য ও সময়মতো বিল পরিশোধ না করার ফলে ভাল মানের আইটি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কমছে এবং প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
বৈদেশিক রেমিট্যান্স
বৈদেশিক রেমিট্যান্সের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের আইটি খাত থেকে বৈদেশিক রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাৎসরিক প্রায় ০.৫ বিলিয়ন (৫০০ মিলিয়ন) ডলার থেকে ১ বিলিয়ন (১০০০ মিলিয়ন) ডলার পর্যন্ত। এটি দেশের মোট বৈদেশিক রেমিট্যান্সের একটি ছোট অংশ। বাকী রেমিট্যান্সের বড় অংশ আসে প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে, যারা বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাঠান।
এই অংশ সাধারণত ২০ বিলিয়ন ডলার বা তার বেশি। পার্শ্ববর্তী দেশের ও বাংলাদেশের তুলনা করলে, তাদের মোট বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার। এই ক্ষেত্রে, তাদের আইটি খাতের অবদানটা অনেক বেশি রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে। তাদের আইটি খাত থেকে বছরে প্রায় ৪০-৪৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক রেমিট্যান্স আসে, যা বাংলাদেশের আইটি খাতের রেমিট্যান্সের তুলনায় অনেক বেশি। যেখানে তাদের মোট বৈদেশিক রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ আসে আইটি খাত থেকে, সেখানে বাংলাদেশের এটি প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে আসে এবং আইটি খাতের অবদান তুলনামূলকভাবে খুবই ছোট।
পরিশেষে বলা যায়, আইটি প্রশিক্ষিত কর্মীদের দক্ষতা ও জ্ঞান দেশের অর্থনীতির জন্য অমূল্য। তাদের দ্বারা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে, যা আমাদের অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের উচিত ভালো কোম্পানি গুলোকে সামনে নিয়ে আসা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, আইটি প্রশিক্ষণ, সফট স্কিল ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, যাতে এই ক্ষেত্রের অভিজ্ঞ কর্মীরা অর্থনৈতিক বিকাশের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে দেশে এবং দেশের বাহিরে।