ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

চেয়ারম্যান লাপাত্তা, দুই কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত

দলীয়করণ ও দুর্নীতিতে বিটিআরসিতে অস্থিরতা

প্রকাশিত: ২০:৪১, ১১ আগস্ট ২০২৪; আপডেট: ২১:১৬, ১১ আগস্ট ২০২৪

দলীয়করণ ও দুর্নীতিতে বিটিআরসিতে অস্থিরতা

বিটিআরসি

সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে টানা ১০ দিন ইন্টারনেট বন্ধ রেখে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ।

অভিযোগ রয়েছে, তিনি রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে টেলিযোগাযোগ আইন বহির্ভূতভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং পরিশেষে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। রবিবার দুর্নীতির অভিযোগ এনে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিটিআরসি ভবনের সামনে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারি। এসময় চেয়ারম্যান ও অন্য তিন কমিশনার অনুপস্থিত ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, কেউ কেউ পালিয়েও গেছেন। চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর তিনি তার ঘনিষ্ঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সাবেক প্রচার সম্পাদক মো. আমজাদ হোসেন নিপুকে একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। যদিও মো. আমজাদ হোসেন উপ-পরিচালক, প্রশাসন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রবিবার নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিক্ষোভের মধ্যেই মো. আমজাদ হোসেনসহ আর এক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিটিআরসির প্রশাসন বিভাগের পরিচালক আফতাব মো. রাশেদুল ওয়াদুদ স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়, প্রশাসন বিভাগের উপ-পরিচালক ও একান্ত সচিব মো. আমজাদ হোসেন নিপু এবং ইঞ্চিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের উপ-পরিচালক মাহদী আহমদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আরও বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে কর্মচারিগণকে নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের অভিযোগে এবং গণমাধ্যমে তাদের দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় তাদের চাকরি প্রবিধিমালা অনুযায়ী চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।জানা গেছে, চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব হিসেবে নির্ধারিত কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও আমজাদ হোসেনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করে এই নিয়োগ সে সময় ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বিধি-১ শাখা থেকে ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিলে প্রকাশিত চলতি ও অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান নীতিমালা, ২০২৩ বিধি-৪ এর সম্পূর্ণভাবে ব্যত্যয় হিসেবে পরিগণিত হয়। একান্ত সচিব হিসেবে পদায়নের পর মো. আমজাদ হোসেন চেয়ারম্যানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিটিআরসিতে নিজস্ব বলয় গড়ে তোলেন।

বিটিআরসি’র কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমজাদ হোসেন প্রশাসন বিভাগের ক্রয় সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পাশপাশি চেয়ারম্যানের পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়োগ ও সংস্থাটির অন্যান্য কাজে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সরিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তার অনুসারীদের পদায়ন করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

আরও অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যান শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায় সারাদেশের সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে পাঁচ শতাধিক আইএসপি লাইসেন্স প্রদান করেন। এ সকল দলবাজ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় দশ হাজার কর্মচারীকে এবার ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মাঠে নামানোর গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
বিটিআরসি’র টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চেয়ারম্যান আগের কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করে তার মূল সহযোগীদের দায়িত্ব প্রদান করেন। এ ছাড়া, ক্রয় প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কমিটিতে আজ্ঞাবহ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রদান করেন। সম্প্রতি, রেডিয়েশন পরিমাপক সংক্রান্ত ১৫ কোটি টাকার দরপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পূর্বের কমিটি সংশোধন করেন। এ ক্ষেত্রে পিপিআর এর বিধি বহির্ভূতভাবে দরপত্র উন্মুক্ত করার মাত্র ১ ঘণ্টা আগে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরিয়ে কমিটি সংশোধন করে আজ্ঞাবহ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করেন, যা বিটিআরসির ইতিহাসে নজিরবিহীন। কমিশনারকে (অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগ) এড়িয়ে চেয়ারম্যান তার সিন্ডেকেট সদস্য অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের পরিচালক অর্থকে ব্যবহার করে কমিশনের অর্থ ব্যবস্থাপনাতেও ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। 

টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন গাইডলাইন, নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ ও আইটিইউ এর গাইডলাইন অনুসরণ না করার ফলে টেলিকম খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রভাব ফেলেছে।    

সীমাহীন দলীয়করণ, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী কার্যক্রমের কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলতা ও অব্যবস্থাপনা। কোনো নিয়ম নীতির অনুসরণ না করার ফলে লাইসেন্সধারী অপারেটরদের মাঝে অসন্তোষ চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। ফলে পুরো সেক্টরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে, তারা যে কোনো সময়ে বিটিআরসি ভবন ঘেরাও করার মতো কর্মসূচি প্রদান করতে পারে মর্মে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। এ ছাড়া, বিটিআরসির সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে কোনো সময়ে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।

ছাত্র আন্দোলনের ফলে সরকারের পতন ঘটলে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এ অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষিতে উক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যে পদ থেকে সরানো হলেও বিটিআরসিতে এই ধরনের দুর্নীতিবাজ এবং দলীয় পদধারীরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এখনো কেন তাদের পদ থেকে সরিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খাত সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীরা। সেইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় যে কোনো সময় তারা বিদেশ পালিয়ে যেতে পারেন বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।

আরএস/

×