
আইপি-টিভি । প্রতীকী ছবি
টেলিভিশন আবিষ্কার প্রযুক্তির জন্য একটি মাইলফলক ছিল। আবিষ্কারের পর থেকেই এটি তথ্য এবং বিনোদনের অন্যতম কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে আসছে যার সাথে আমরা সবাই পরিচিত।
আমাদের দেশে চলমান টেলিভিশন সম্প্রচার মাধ্যম মূলত টেরিস্টেরিয়াল (ক্যাবল ও ওয়্যারলেস) এবং স্যাটেলাইট ভিত্তিক। এখন পরিচিত হবো আইপিটিভি’র সাথে। আইপিটিভি হল একটি প্রযুক্তি যা ইন্টারনেট প্রোটোকল (আইপি) নেটওয়ার্কের মাধ্যমে টেলিভিশনসমূহ তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত করে। প্রথাগত সম্প্রচার, স্যাটেলাইট বা এনালগ ক্যাবল টেলিভিশন ফরম্যাটের বিপরীতে। আইপিটিভি সাধারণত ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ওঝচ) দ্বারা সম্প্রচার করা হয় এবং একটি সেট-টপ বক্স, স্মার্ট টিভি বা অন্যান্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ডিভাইসের মাধ্যমে অ্যাক্সেস করা হয় এবং এই সম্প্রচার ঐ আই এস পির অন্তর্ভুক্ত থাকে।
১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে, আইপি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে টেলিভিশন কন্টেন্ট প্রথম সম্প্রচার পরীক্ষা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আইপি টিভি শব্দটি প্রথম ১৯৯৫ সালে জুডিথ এস্ট্রিন এবং বিল ক্যারিকোর দ্বারা প্রিসেপ্ট সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। তখন আইপি/টিভি ছিল একটি এমবোন সামঞ্জস্যপূর্ণ উইন্ডোজ এবং ইউনিক্স-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন। যা আইপি ইউনিকাস্ট ও মাল্টিকাস্ট রিয়েল-টাইম ট্রান্সপোর্ট প্রোটোকল (RTP) এবং রিয়েল টাইম কন্ট্রোল প্রোটোকল (RTCP) উভয় ব্যবহার করে একক এবং মাল্টি-সোর্স অডিও এবং ভিডিও ট্র্যাফিক, নিম্ন থেকে ডিভিডি মানের পর্যন্ত প্রেরণ করে। ১৯৯৮ সালে সিসকো সিস্টেমস দ্বারা প্রিসেপ্ট অধিগ্রহণ করা হয়। ২০০০ শতকের গোড়ার দিকে, আইপিটিভি সারা বিশ্বে বিভিন্ন সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা প্রদান শুরু করে। উন্নত বিশ্বে আজ, আইপিটিভি হল টেলিভিশন দেখার অন্যতম জনপ্রিয় উপায়। আইপিটিভি ডিজিটাল হওয়ায় প্রথাগত টেলিভিশনের তুলনায় অনেক সুবিধা প্রদান করে। উচ্চতর ছবির গুণগতমান যেমন হাই-ডেফিনিশন এবং এমনকি 4K আল্ট্রা হাই-ডেফিনিশন ভিডিও সম্প্রচার করতে পারে, যা এনালগ টেলিভিশনের ছবির গুণমান থেকে অনেক বেশি উন্নত। ব্যবহারকারীরা তাদের নিজস্ব সুবিধামত অটো ইন্সট্রাকশনের মাধ্যমে পছন্দের অনুষ্ঠান রেকর্ড করে পরে যেকোনো সময়ে দেখতে পারেন। তবে বলে রাখা ভাল যে, আইপিটিভি সংযোগের ক্ষেত্রে আইএসপি একটা জরুরী ভূমিকা পালন করে, সেটি হল দ্রুত গতির ইন্টারনেট। আপনার ইন্টারনেট সংযোগ ধীরগতি বা অবিশ্বস্ত হলে, আপনি বাফারিং বা অন্যান্য সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। আইপিটিভির প্রযুক্তিগত আর্কিটেকচারকে প্রধানত দুইটি স্তরে বিভক্ত করা যেতে পারে ১) Headend ২) Network
১) Headend- এই স্তরটি নেটওয়ার্কের ভিডিও সামগ্রী অর্জন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিতরণের জন্য কাজ করে। এতে পরবর্তী কাজগুলি অন্তর্ভুক্ত যেমন- ক) কন্টেন্ট ডাউনলিংক: এখানে স্যাটেলাইট ফিড, সম্প্রচার চ্যানেল এবং অনলাইন স্ট্রিমিং পরিষেবার মতো বিভিন্ন উৎস থেকে কন্টেন্ট ডাউনলিংক করা হয়। খ) কন্টেন্ট প্রক্রিয়াকরণ: ডাউনলিংকৃত বিষয়বস্তু প্রয়োজনীয় গুণগতমান এবং পুনঃসম্প্রচার মান নিশ্চিত করার জন্য তার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এখানে মুলত মাল্টিপ্লেক্সিং, এনকোডিং, ট্রান্সকোডিং, মেটাডেটা এবং প্যাকেজিং নিয়ে কাজ করা হয়। গ) কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক: প্রক্রিয়াকৃত বিষয়বস্তু শেষ-ব্যবহারকারীর কাছে দক্ষ ডেলিভারি নিশ্চিত করতে সার্ভারের একটি নেটওয়ার্কে সংরক্ষণ ও বিতরণ করা হয়। ঘ) অ্যাক্সেস নেটওয়ার্ক: এই স্তরটি আইপিটিভি প্রদানকারীর নেটওয়ার্ক এবং গ্রাহকের মধ্যে সংযোগ প্রদান করে। এখানে ব্রডব্যান্ড রিমোট অ্যাক্সেস সার্ভার হল একটি নেটওয়ার্ক ডিভাইস যা ব্যবহারকারীর প্রমাণীকরণ, অনুমোদন এবং অ্যাকাউন্টিং পরিচালনা করে। এটি ট্রাফিক শেপিং এবং কোয়ালিটি অফ সার্ভিস ম্যানেজমেন্টও প্রদান করে। ঙ) ডিজিটাল সাবস্ক্রাইবার লাইন অ্যাক্সেস মাল্টিপ্লেক্সার : ডিএসএলএএম গ্রাহকদের থেকে একাধিক ডিএসএল সংযোগ একত্রিত করে এবং তাদের BRAS-এর সাথে সংযুক্ত করে। চ) সেট-টপ বক্স: STB হল এমন একটি ডিভাইস যা আইপিটিভি সংকেতকে ডিকোড করে এবং গ্রাহকের টেলিভিশনে প্রদর্শন করে। এটি ইন্টারেক্টিভ বৈশিষ্ট্যগুলিও প্রদান করে, যেমন প্রোগ্রাম গাইড, রেকর্ডিং ইত্যাদি।
২) নেটওয়ার্ক: এই স্তরটি আইপিটিভি নেটওয়ার্কের মেরুদন্ড, যা সিস্টেমের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ট্রাফিক রাউটিং এবং স্যুইচ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটির পরবর্তী ধাপগুলি হলো- ক) উচ্চ-ব্যান্ডউইথ রাউটার এবং সুইচ খ) অপটিক্যাল ফাইবার লিঙ্ক গ) ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম
এছাড়াও আইপিটিভিতে ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি প্রোটোকল রয়েছে যেমন- ক) এইচটিটিপি লাইভ স্ট্রিমিং (HLS) খ) ইন্টারনেট গ্রুপ ম্যানেজমেন্ট প্রোটোকল (IGMP) গ) রিয়েল-টাইম ট্রান্সপোর্ট প্রোটোকল (RTP) ঘ) রিয়েল-টাইম মেসেজিং প্রোটোকল (RTMP)
একটি IPTV সবার জন্য নির্দিষ্ট প্রোটোকল ব্যবহৃত হয় যা সেবা অ্যাক্সেস করতে ব্যবহৃত ডিভাইসগুলির উপরও নির্ভর করবে।
আরোও কিছু কারিগরি বিষয় যেমন- H.২৬৪ এবং H.২৬৫: এগুলি হল ভিডিও কম্প্রেশন স্ট্যান্ডার্ড যা সাধারণত IPTV-তে ব্যবহৃত হয়। H.২৬৪ এবং H.২৬৫ খুব দক্ষতার সাথে ভিডিও ডেটা সংকুচিত করতে পারে, যা IPTV বিষয়বস্তু প্রেরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যান্ডউইথকে হ্রাস করে। MPEG ট্রান্সপোর্ট স্ট্রীম- এটা হল অডিও এবং ভিডিও ডেটা এনক্যাপসুলেট করার একটি ফর্ম্যাট। এটি সাধারণত RTP প্যাকেট পরিবহন করতে IPTV-তে ব্যবহৃত হয়।
নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে IPTV অন্যান্য নিরাপত্তা সেবা সংযুক্ত করে। যেমন: ডিজিটাল রাইটস ম্যানেজমেন্ট (DRM) হল অননুমোদিত অ্যাক্সেস থেকে কপিরাইটযুক্ত বিষয়বস্তু রক্ষা করতে DRM ব্যবহার করা হয়। আইপিটিভি সেবা প্রদানকারীরা ইপিজি ব্যবহার করতে পারে যাতে গ্রাহকরা প্রোগ্রামগুলো ব্রাউজ এবং অনুসন্ধান করতে পারে। ডিজিটাল ও আইপিটিভি একটি দ্রুত বর্ধনশীল প্রযুক্তি এবং এটি আগামী বছরগুলিতে জনপ্রিয় হতে থাকবে।
ডেটা ব্রিজ মার্কেট রিসার্চ এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী আইপিটিভি বাজার ২০২২ সালে ৩৪৭১৭.৮৮ মিলিয়ন ডলার আয় করে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সেটা ৬৬৬৫৪.৪৭ মিলিয়নে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হাই-ডেফিনিশন এবং আল্ট্রা-হাই-ডেফিনিশন সামগ্রীর ক্রমবর্ধমান চাহিদা, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশ, স্মার্ট টিভি এবং অন্যান্য সংযুক্ত ডিভাইসের ক্রমবর্ধমান প্রাপ্যতা এই বাজারটিকে সম্প্রসারিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন মিডিয়ার তথ্য এবং বিনোদন বিভাগতো আছেই যারা এই বৃহত্তম বাজার তৈরি করার জন্য সবচেয়ে সহায়ক নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।
আবাসিক ব্যবহারের পাশাপাশি বাণিজ্যিক এবং কর্পোরেট সেক্টরে কোথায় কোথায় টিভির ব্যবহার হচ্ছে তার কিছু ধারণা নেয়া যাক। যেমন- অফিস, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, অবকাশ কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসালয়, বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্র ইত্যাদি।
আমাদের দেশে পূর্ণাঙ্গভাবে ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করা গেলে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক ভাবেও লাভবান হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৮ কোটি টিভি সেট আছে যার গড় আয় প্রতিটি থেকে ২০০ টাকা করে হলেও ১৬০০ কোটি টাকা। যার মূল্য সংযোজন কর হতে পারে প্রায় ২৪০ কোটি টাকা।
টিভি হল একটি বহুল ব্যবহৃত জিনিস। তাই এর প্রযুক্তি যথেষ্ঠ গুরুত্ব বহন করে যা সকল আকারের ব্যবসায় বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।