ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্লাউড সিডিং কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের প্রযুক্তি

টুটুল মাহফুজ

প্রকাশিত: ০০:১৪, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

ক্লাউড সিডিং কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের প্রযুক্তি

.

সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ চেষ্টা করে এসেছে প্রকৃতির উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারসেই পথে মানুষের সাফল্যের ফিরিস্তিও বেশ দীর্ঘমানুষ বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ বদলে দিয়েছে, প্রণালী কেটে সাগরের সঙ্গে মিলিয়েছে মহাসাগর, মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আস্তানা গেঁড়েছে মহাশূন্যে! প্রকৃতি শাসনের ফল কখনও হয়েছে আশীর্বাদ, কখনও বা ডেকে এনেছে চরম বিপর্যয়তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে প্রকৃতির মৌলিক কাঠামোগুলোতে মানুষের নিয়ন্ত্রণ দিন দিন আরও বহুলাংশে বাড়বে সন্দেহ নেইএমনই এক যুগান্তকারী প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক আজ

মানুষ এবং অসংখ্য প্রাণীর টিকে থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান স্বাদু পানি, যার একমাত্র প্রাকৃতিক উস বৃষ্টিপাতকিন্তু এই বৃষ্টির উপর তো আর কারও নিয়ন্ত্রণ নেইপ্রাণীকুলের প্রয়োজনমাফিক দিন-তারিখ-সময় ধরে বৃষ্টি নামবে, এমনটাও সবসময় আশা করা যায় নাকেমন হতো যদি বৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে থাকত? যার যখন যেখানে প্রয়োজন একটু বৃষ্টি ঝরিয়ে নিলেই হলো! কল্পনার মতো শোনালেও বৃষ্টির উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ মানুষ অনেক আগেই প্রতিষ্ঠা করেছেকৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোর সেই পদ্ধতির নামই ক্লাউড সিডিং

ক্লাউড সিডিং যেভাবে কাজ করে

ক্লাউড সিডিংয়ের পদ্ধতি খুব জটিল কিছু নয়আকাশে বৃষ্টির অনুপযোগী মেঘগুলোর উপর কেমিক্যাল ছড়িয়ে দিয়ে সময়ের আগেই বৃষ্টি ঝরিয়ে ফেলা হয়, যাকে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতও বলা যেতে পারেআদতে, বৃষ্টির মূলমন্ত্র হচ্ছে মেঘের ঘনীভবন, যা প্রাকৃতিকভাবে ঘটে থাকে

এখন এই ট্রপোস্ফিয়ারে থাকা মেঘগুলোকে যদি সময়ের আগেই কৃত্রিমভাবে ঘনীভূত করা যায়, তবেই তক্ষণা বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যাবেক্লাউড সিডিংমূলত এই কাজই করে থাকেবিমান, রকেট বা মিসাইলের সাহায্যে মেঘের উপর ড্রাই আইস (জমাটবাধা কার্বন ডাই অক্সাইড), সিলভার আয়োডাইড, পটাসিয়াম আয়োডাইড, তরল প্রোপেন গ্যাস, এমনকি পটাসিয়াম ক্লোরাইড (লবণ) ছড়িয়ে দিলেও তা মেঘগুলোকে দ্রুত ঘনীভূত হতে সহায়তা করে এবং যার ফলে বৃষ্টিপাত ঘটেএকই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৃষ্টির পাশাপাশি কৃত্রিম তুষারপাত ঘটানো হয়বর্তমানে ক্লাউড সিডিং করার জন্য সিলভার আয়োডাইডই সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও জনপ্রিয়

শুরু হয়েছিল যেভাবে

ক্লাউড সিডিং’-এর জনক বলা হয় মার্কিন রসায়নবিদ ভিনসেন্ট শায়েফারকেযুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিকের গবেষণাগারে শায়েফার ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের সফল ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটানপরবর্তীতে আরেক নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী আরভিং ল্যাংমুর যোগ দেন শায়েফারের সঙ্গেদুই বিজ্ঞানী মিলে একই বছরের ১৩ নবেম্বরে বার্কশায়ারের পাহাড়ী এলাকার উন্মুক্ত পরিবেশে মানব ইতিহাসে প্রথম ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটাতে সক্ষম হনমজার ব্যাপার হচ্ছে শায়েফারের রসায়নবিদ্যায় কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রীই ছিল নামৃত্যুর আগে ১৪টি পেটেন্ট রেখে যাওয়া স্বশিক্ষিত এই বিজ্ঞানী কখনও হাইস্কুলের গ-ি পরুতে পারেননি

বিতর্ক বনাম সফল প্রয়োগ

ক্লাউড সিডিং কতটা কার্যকর বা এই প্রযুক্তিতে আদৌ বার্ষিক বৃষ্টিপাতের মাত্রা বৃদ্ধি করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা আছেএকদল বিজ্ঞানী মনে করেন, এই পদ্ধতিতে ঘটানো কৃত্রিম বৃষ্টিপাত দীর্ঘমেয়াদে খুব সামান্যই কাজে আসেএছাড়া অতিরিক্ত ক্লাউড সিডিংয়ের ফলে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারেএতে ব্যবহৃত কেমিক্যাল স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারেতবে স্বল্পমেয়াদে বা তাক্ষণিক প্রয়োজনে ক্লাউড সিডিংয়ের কার্যকারিতা প্রমাণিত

উদাহরণ হিসেবে ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের কথা বলা যায়গ্রীষ্মকালীন এই অলিম্পিক শুরুর আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে গেমস উদ্বোধনের দিন বেইজিং শহরে ভারি বর্ষণের কথা বলা হয়েছিল১০০ মিলিয়ন ডলারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বৃষ্টির উপদ্রƒপকে সহ্য করবে! অতঃপর চীন এক অভাবনীয় কাজ করে বসেসমুদ্র থেকে বেইজিংয়ের দিকে উড়ে আসা মেঘগুলোর উপর গেমসের আগের কয়েকদিন সর্বমোট ১,১০৪টি কেমিক্যাল ভর্তি রকেট ছুড়ে মারেফলাফল? বেইজিংয়ের আকাশে ঢোকার আগেই মেঘগুলো বৃষ্টি ঝরিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, এবং ৮ আগস্ট ২০০৮ ঝকঝকে আকাশের নিচে বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়ামে নির্বিঘেœ সম্পন্ন হয় গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানচীনের কথা যখন উঠল, তখন বলে রাখা যাক, পৃথিবীতে বর্তমানে যত পরিমাণে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয় তার অধিকাংশই করে থাকে চীন

ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি যখন যুদ্ধাস্ত্র!

অবাক শোনালেও এটাই সত্য! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই ১৯৬৭ সালেই ভিয়েতনাম যুদ্ধে নজিরবিহীনভাবে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেঅপারেশন পপাইনামে কুখ্যাত এই অভিযানে মার্কিনীরা ক্লাউড সিডিং করে ভিয়েতনামের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের সংযোগকারী হো চি মিন ট্রেইলের উপর প্রচুর পরিমাণে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটায়মূলত এর ফলে বন্যা ও ভূমিধসে ভিয়েতনাম বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়উত্তর ও দক্ষিণ অংশের মধ্যে খাদ্য ও অস্ত্র পরিবহন কঠিন হয়ে ওঠে

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে

কৃত্রিম বৃষ্টিপাত যেমন ব্যবহৃত হয়েছে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে, আবার মানুষের জীবন বাঁচাতেও এর ব্যবহার হয়ে আসছে হরহামেশা, যার সাম্প্রতিক নজির ইন্দোনেশিয়া২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় প্রবল বর্ষণ ও ভূমিধসে ৩ দিনেই প্রায় ৪৩ জন মানুষ প্রাণ হারায়আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আশঙ্কা করা হয়েছিল আরও অন্তত দুসপ্তাহ ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারেইন্দোনেশীয় সরকার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমাতে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার মধ্যে ক্লাউড সিডিং অন্যতমজাকার্তা উপসাগরে উপন্ন মেঘগুলোর উপর সোডিয়াম ক্লোরাইড ছড়িয়ে সেগুলোকে শহরে ঢুকতে বাধা সৃষ্টি করা হয়শহরে ঢোকার আগেই তসংলগ্ন নদীতে কিছুটা বৃষ্টিপাত হয়ে যাওয়ায় মেঘগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, রক্ষা পায় প্রাণ ও সম্পদ

বহুবিধ ব্যবহার

বর্তমানে বহু দেশ তাদের বৃষ্টিনির্ভর শস্য উপাদনে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছেকৃষিক্ষেত্রে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করার দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে থাইল্যান্ডথাই সরকার ১৯৫৫ সালে থেকে সরকারীভাবে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর প্রকল্প চালিয়ে আসছে যা প্রধানত দেশটির বৃষ্টিনির্ভর শস্যগুলো রক্ষায় কাজে আসছে

অনাবৃষ্টি ও মরু অঞ্চলে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত যে কত বড় আশীর্বাদ হতে পারে তার সফল উদাহরণ সংযুক্ত আরব আমিরাতমরু ও সাগর পরিবেষ্টিত নদীশূন্য এই দেশে প্রতিবছর গড়ে মাত্র দশদিন বৃষ্টি হয়, যার পরিমাণ সবমিলিয়ে মাত্র ১২০ মিলিমিটারশুধু তা-ই নয়, দেশটির ভূগর্ভস্থ পানির শতকরা নব্বই শতাংশই লবণাক্তএই শতকের শুরু থেকেই সেখানকার সরকার বৃষ্টিপাত বাড়াতে বৃহ কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে আছে বৃষ্টি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃহ পরিসরে গবেষণা, ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তির উন্নয়ন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম হ্রদ ও বাঁধ নির্মাণআমিরাতের জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্রের একটি দল সার্বক্ষণিক মেঘ পর্যবেক্ষণ করে থাকে, এবং বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে এমন মেঘ খুঁজে পেলেই ক্লাউড সিডিং অপারেশন শুরু করে

কেবল ২০১৭ সালেই তারা ২৪২টির মতো সফল ক্লাউড সিডিং অপারেশন সম্পন্ন করে যা ১৫-৩০ শতাংশের মতো বৃষ্টিপাত বৃদ্ধিতে সহায়তা করেআমিরাত শুধু কৃত্রিম বৃষ্টিপাতই নয়, সমৃদ্রের লবণাক্ত পানি পরিশোধনের ক্ষেত্রেও রোল মডেলসেদেশের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানির ৯৯ শতাংশই পরিশোধিত সমুদ্রের পানি!

কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের ভবিষ্যত কী?

প্রযুক্তি থেমে থাকে নাদিন দিন এর প্রভূত উন্নয়ন যেমন হয়, আবার সম্পূর্ণ নতুন কোন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে আগের সব ধারণা ভেঙে যায়ক্লাউড সিডিং এখনও যথেষ্ট ব্যয়বহুলবিমান বা রকেটের পরিবর্তে লেজার রশ্মির ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চলছে, যা কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের প্রযুক্তিকে সহজ ও সুলভ করতে পারে

এবার আরও একটু সামনে তাকান যাকহয়ত অচিরেই আমরা এমন প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করতে পারব যা শুধু আকাশে ভেসে থাকা মেঘগুলোকে ছেঁকে এনে বৃষ্টি ঝরাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমুদ্র থেকে ইচ্ছেমতো পানিকে বাষ্পীভূত করে মেঘ সৃষ্টিতেও সক্ষম হবেচিন্তা করুন তো, ভবিষ্যতের কোন একদিন হয়তো দিনাজপুরের কয়েক হেক্টর ধানি জমিতে সেচ দেয়ার জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে মেঘ তৈরি করে সেগুলোকে উড়িয়ে এনে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট জায়গায়, ঠিক নির্দিষ্ট পরিমাণ বৃষ্টিই ঝরানো হচ্ছে! অতিকল্প মনে হচ্ছে? মানুষের কাছে অতিকল্প বলে কিছু নেই, তাই আশায় বুক বাঁধতেও বাধা নেই!

×