
মোবাইল ফোনভিত্তিক গ্রাহক সেবা
পৃথিবীব্যাপী মোবাইল ফোন বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে মোবাইল ফোনভিত্তিক গ্রাহক সেবা। জীবন যাত্রায় আর্থিক লেনদেন যেহেতু বড় রকমের ভূমিকা পালন করে, সেহেতু বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকিং কোম্পানি তাদের সেবাগুলোকে মোবাইল ফোন নির্ভর করে তুলছে। অন্যদিকে ই-কমার্স, ই-সেবাভিত্তিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে লেনদেন সংক্রান্ত জটিলতাগুলোকে সহজ করতে মোবাইল ফোন নির্ভর সেবার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বড় বড় টেক জায়ান্টগুলো। এমন একটি সেবাই ‘ডিজিটাল ওয়ালেট’ বা ‘ই-ওয়ালেট’ নামে পরিচিত।
ডিজিটাল ওয়ালেট
ডিজিটাল ওয়ালেট হচ্ছে সাধারণ ওয়ালেট বা মানিব্যাগের ইলেকট্রনিক সংস্করণ। এই প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ভোক্তারা কাগজের মুদ্রার পরিবর্তে মূল্য পরিশোধ সংক্রান্ত ঝামেলাগুলো ভার্চুয়াল মাধ্যমে মেটাতে পারে। তবে এখানে, ভার্চুয়াল কারেন্সি না, বরং দেশের প্রচলিত কারেন্সির লেনদেনই ভার্চুয়ালি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মতো টাকা আদান প্রদানে ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার সঙ্গে এই প্রযুক্তির মূল পার্থক্য হচ্ছে, খুচরা লেনদেনে ডিজিটাল ওয়ালেটের স্বতঃস্ফূর্ততা।
প্রচলিত কাগজের মুদ্রার মতো ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমেও খুব সহজেই যে কোন পরিমাণ টাকা আদান প্রদান করা যায়। এছাড়া, ডিজিটাল ওয়ালেট সাধারণ ওয়ালেটের মতো কনসার্ট ও মুভি-থিয়েটারের টিকেট, বাস ও সাবওয়ের ছাড়পত্র, গিফট কার্ডসহ কোন কিছু কেনার পর ওই পণ্যের ভাউচার সংরক্ষণ করে রাখতেও সক্ষম। এমনকি, ডিজিটাল ওয়ালেটে গ্রাহকের ডেভিড কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি ওই তথ্য ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবাগুলোও নিশ্চিত করা যায়।
ডিজিটাল ওয়ালেট মূলত দুই ধরনের হয়। ক্লায়েন্ট-সাইড ওয়ালেট ও সার্ভার-সাইড ওয়ালেট। এই দুটি ক্যাটাগরির উপর নির্ভর করেই ওয়ালেট সেবাগুলো অফলাইন নাকি অনলাইন, কিংবা ব্যবহারকারীর নাকি কোন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন হবে তা নিশ্চিত করে। ক্লায়েন্ট-সাইড ওয়ালেট সাধারণত ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রণাধীন। ব্যবহারকারীকে ব্যক্তিগত স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে একটি এ্যাপলিকেশন ইন্সটল করতে হয় এবং পেমেন্ট সংক্রান্ত তথ্যাদি ইনপুট দেয়ার পাশাপাশি কোন সেবা বা পণ্যের মূল্য পরিশোধের জন্য ব্যক্তিগত ব্যাংক এ্যাকাউন্টের সঙ্গে সংযুক্ত করে অথবা অন্য কোনভাবে টাকা রিচার্জ করে এ্যাপ্লিকেশনটিকে সচল করতে হয়।
ক্লায়েন্ট সাইড ওয়ালেটের প্রধান সমস্যা হচ্ছেÑ সামঞ্জস্যপূর্ণ এ্যাপ্লিকেশন ও ইন্টারনেট ছাড়া এটি ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
তাছাড়া ওই সেবা যদি থার্ড পার্টি এ্যাপ্লিকেশন হয়ে থাকে, তাহলে ওই এ্যাপ ব্যবহার করার জন্য হয়ত ব্যবহারকারীকে আলাদা চার্জও দিতে হতে পারে। এমনকি যেহেতু মাঝে মাঝে পুরো প্রক্রিয়াটিতে থার্ড পার্টি এ্যাপ্লিকেশনের ভূমিকা থাকে সেহেতু ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা এবং আর্থিক নিরাপত্তার সংক্রান্ত জটিলতাগুলোর ব্যাপারেও গ্রাহককে সচেতন থাকতে হয়। তবে এই ওয়ালেট ব্যবস্থাটি স্বাধীন ব্যবহার বিধি নিশ্চিত করে এবং দৈনন্দিন জীবনে পেমেন্ট সংক্রান্ত তথ্যাদিগুলোর বারবার ব্যবহারকে আরও সহজ করে দেয়। এছাড়াও ক্লায়েন্ট-সাইড ডিজিটাল ওয়ালেটই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোক্তাকে একের অধিক পেমেন্ট মেথড ব্যবহারের সুযোগ দেয়।
অন্যদিকে, সার্ভার-সাইড ওয়ালেট পুরোপুরি বিপরীত। এই ওয়ালেট ব্যবস্থায় ব্যবহারকারীকে একটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন হতে হয়। ওই কোম্পানির সার্ভারে ব্যবহারকারীর নামে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তসহ একটি নিবন্ধিত এ্যাকাউন্ট থাকে এবং ওই এ্যাকাউন্টে প্রবেশ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হয়। তবে সার্ভার-সাইড ওয়ালেটের মূল সমস্যা হচ্ছে, এর সীমাবদ্ধতা।
নিরাপত্তা ও সুবিধা-অসুবিধা
ডিজিটাল লেনদেনের ব্যাপারটির ক্ষেত্রে ‘নিরাপত্তা’ এবং ‘গোপনীয়তা’র মতো দুটো প্রচলিত শব্দ বরাবরের মতোই মানুষের মাঝে আশঙ্কা তৈরি করে। মানুষ খুব সহজেই চিন্তা করে বসে থাকে, পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কিছু সাইবার অপরাধী তাদের টাকা মেরে দেয়ার ধান্দায় বসে রয়েছে। ডিজিটাল ওয়ালেট সেবার জটিলতাগুলোর কারণে এই ধরনের উদ্বেগ আরও বেশি জোরালো। কেননা, এই সেবা ব্যবহার করে ভোক্তা এবং বিক্রেতার মাঝে খুব সহজে লেনদেন সম্পন্ন করা গেলেও, টেকনিক্যালি পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং কয়েকটি ভাগে বিভক্ত।
ক্লায়েন্ট সাইড ওয়ালেটের কথাই ধরা যাক। প্রথমত, নিজের মোবাইল ফোনে একটি এ্যাপ ইন্সটল করতে হয়। এরপর ওই এ্যাপে নিজের এবং ব্যাংক এ্যাকাউন্টের তথ্য দিয়ে একটি লগইন করার ব্যাপারটি আসে। এ্যাপটি একটি সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। ওই সার্ভারটি লেনদেনের সময় গ্রাহকের এ্যাকাউন্টের সঙ্গে বিক্রেতার এ্যাকাউন্টের ডাটা বাইপাস করে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে। এসব ধাপের কোন একটিতে নিরাপত্তাজনিত ত্রুটি দেখা দিলেই হয়ত ভোক্তা তার সব জমাকৃত অর্থ বা গোপন কোন তথ্য হারাতে পারেন। এ কারণে, পুরো ব্যাপারটি বেশ উদ্বেগেরই।
কিন্তু স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, ডিজিটাল ওয়ালেট সেবাভিত্তিক এ্যাপ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সার্ভারসহ সব কিছুই অতিরিক্ত নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকে। অনলাইন এবং অফলাইন, যে কোন মাধ্যমে লেনদেনের সময় প্রেরক এবং প্রাপকের মধ্যে যে অদৃশ্য যোগাযোগ হয়, তা পুরোপুরি ডিজিটাল সার্টিফিকেশনের আওতাধীন। অর্থাৎ, সবকিছু এনকোডেড।
এ কারণে, হ্যাকারদের দ্বারা রিমোটলি ভোক্তার ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্টে ঢুকে ক্ষতিসাধন করা সম্ভব নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর সচেতনতা, নিরাপত্তা জনিত সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারে। যেমন পাসওয়ার্ড কাউকে না জানানো এবং সহজেই ধারণা করা যায় এমন পাসওয়ার্ড দিয়ে নিজের ফোন অন্য কারও কাছে রেখে না যাওয়া; অর্থাৎ, কাউকে ঘরের শত্রু বিভীষণ হওয়ার সুযোগ না দিলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়।
অন্যদিকে, ডিজিটাল ওয়ালেট সাধারণ ওয়ালেট বা ডেবিট, ক্রেডিট কার্ড থেকে বেশি নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। আপনার ওয়ালেট হারানো বা চুরি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নগদ অর্থ হারানো সম্ভাবনা তৈরি হয়। পাশাপাশি, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড হারিয়ে ফেললে, সেগুলো পুনরায় পাওয়া বেশ সময় সাপেক্ষ। কিন্তু ডিজিটাল ওয়ালেটে এই সমস্যা নেই। ফোন হারিয়ে ফেললেও টাকা চুরি যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এমনকি, খুব সহজেই ব্যবহৃত সিম কার্ডটি উদ্ধার করা যায়।
যেহেতু অফলাইন, অনলাইন দুটি সেবার ক্ষেত্রেই ফোনের চার্জের উপর নির্ভর করতে হয়, সেহেতু মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেলে সমস্যা সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যার সমাধানও হচ্ছে। যেমন নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন বা এনএফসি প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত চিপগুলো ব্যবহারের জন্য কোন রকমের চার্জের প্রয়োজন হয় না। ওই চিপের সঙ্গে সংযুক্ত ম্যাগনেটিক ফিল্ড থেকেই শক্তি উৎপাদন করে সেটি কাজ চালাতে পারে। তাছাড়া বর্তমানে মোবাইল ফোনের সঙ্গে সংযুক্ত এনএফসি চিপগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্থিক লেনদেন পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয়। যে কারণে, এগুলো এনক্রিপটেড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ শক্তিশালীও হয়ে থাকে। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে হয়তো চার্জ বিহীন মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও ডিজিটাল ওয়ালেট সেবা ব্যবহার করা যাবে।
ডিজিটাল ওয়ালেটের বর্তমান ও ভবিষ্যত
বর্তমানে, ডিজিটাল ওয়ালেট প্রযুক্তির দ্বিতীয় প্রজন্ম চলছে। উন্নত বিশ্বে এই প্রযুক্তি নিয়ে নানা উদ্ভাবনী কাজ হওয়ার পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও বিভিন্ন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় সীমিত সেবামূলক ডিজিটাল ওয়ালেট ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় বেশির ভাগ মানুষ নিয়মিত সেবা-পণ্য কিনতে ডিজিটাল ওয়ালেট প্রযুক্তির ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশেও বিকাশ, রকেট, ইউক্যাশ, এমক্যাশের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবাগুলোও ই-ওয়ালেট সেবার মান বৃদ্ধি করছে। নামী-দামী, বৃহৎ পণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি স্বতন্ত্র মালিকানাধীন ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোও ভোক্তাদের সঙ্গে লেনদেনে এসব সেবা ব্যবহার করছে। গত বছরের নবেম্বরে ডাচ বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ডাটা সফট ও ফাইনটেক সহযোগিতায় বাজারে এসেছে ‘পে ৩৬৫’য়ের মতো ডিজিটাল ওয়ালেট সেবা। তাছাড়াও রয়েছে দেশে এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও ডিজিটাল ওয়ালেট সেবা ‘পাঠাও-পে’। অন্যদিকে, এই খাতে তরুণ উদ্যোক্তাদের দ্বারা ‘মুঠোপে’র মতো দেশী স্টার্টআপও তৈরি হয়েছে।