ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিবিসি বাংলা

নিয়ন্ত্রণহীন এবং সর্বগ্রাসী ॥ ডিজিটাল যুগের মোহ

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ২৭ জুলাই ২০১৯

নিয়ন্ত্রণহীন এবং সর্বগ্রাসী ॥ ডিজিটাল যুগের মোহ

গভীর আবেগ নাকি মোহ? যখন কেউ অনলাইনে থাকে তখন মানব আচরণের এই দুটি প্রকাশের মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্য আলাদা করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো, আপনি কি কখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার পুরনো সঙ্গীর খোঁজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন যে, তিন ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পরও আপনি তার নতুন সঙ্গীর সঙ্গে তোলা বিভিন্ন ছবি তখনও দেখছেন? পকেটে কম্পিউটার আর ২৪ ঘণ্টা ইনস্টাগ্রাম ও টুইটার ফিডে প্রবেশাধিকার হাতের নাগালে থাকলে এ ধরনের অযৌক্তিক কাজ করার অন্ধ তাড়না থেকে বের হওয়াটা বেশ কঠিনই বটে। সামাজিক মনোবিজ্ঞানী এবং বিবিসির উপস্থাপক অ্যালেকস ক্রতোস্কি বোঝার চেষ্টা করেছেন যে কিভাবে মোহগ্রস্ত আচরণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তিনি এমন কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন যাদের অন্যের বিষয়ে জানতে চাওয়ার প্রবণতা অনিয়ন্ত্রিত, বাধাহীন এবং সর্বগ্রাসী হয়ে গেছে। সঙ্গে এমন আচরণ থেকে বের হওয়ার উপায়ও বলেছেন তিনি। বিপরীতমুখী ঈর্ষা কিশোর বয়সে প্রেমে পড়েছিলেন জ্যাক স্টকিল। কিন্তু শীঘ্রই তিনি তার বান্ধবীর অতীত জীবন নিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। যদিও এর আগে আর কারও বিষয়ে এমনটা হয়নি তার। তিনি কখনোই একজন ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি ছিলেন না। কিংবা তার বান্ধবী তার তাকে ধোঁকা দিতে পারে এমন আশঙ্কাও ছিল না তার। কিন্তু তার বান্ধবীর সাবেক এক সঙ্গীকে নিয়ে একটি মন্তব্য হঠাৎই তার মস্তিষ্কে একটি সুইচ খুলে দেয়।’ এই একটি জিনিসই আমার মধ্যে পরিবর্তন এনে দেয়,’ জ্যাক বলেন। ‘সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমি তার অতীতের খুব ছোট ছোট বিষয় নিয়েও খুব আগ্রহ বোধ করতাম। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তার প্রেম জীবন কেমন ছিল সেসব নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলাম আমি।’ ‘আমি তার ফেসবুক এ্যাকাউন্টও দেখতাম,’ জ্যাক বলেন, ‘আমি ভাবতাম এই ব্যক্তিটি কেমন? কিংবা ওই ছবিতে কে? এবং এই কমেন্ট দিয়ে কি বোঝায়?’ জ্যাক তার সঙ্গীর অতীত নিয়ে তার কৌতূহলের এমন একটি চক্রে নিজেকে আবিষ্কার করলেন যা অগ্রাহ্য করা তার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। তিনি তার বিপরীতমুখী ঈর্ষাকে দমন করতে ক্রমাগতভাবে অনলাইনে উত্তর খুঁজতেন। কিন্তু এটি তার ওই ঈর্ষাকে দমন না করে বরং তা আরও বাড়িয়ে দিত। সাইবার নজরদারি বা সাইবার স্টকিং সাইবার স্টকিং শব্দটি ২০১০ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে সংযুক্ত করা হয়। এটি হচ্ছে স্টকিং বা কোন ব্যক্তির ওপর অনাকাক্সিক্ষত নজরদারির ডিজিটাল রূপ। যা শুধু অনলাইন জগতেই ঘটে থাকে এবং এটি পুরোপুরি প্রযুক্তিগতভাবেই হয়। স্টিনা স্যান্ডার্স একজন সাংবাদিক যিনি নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সম্পর্কে লেখালেখি করেন। ছয় বছর আগে যখন তার সঙ্গী তাকে কোন কারণ ছাড়াই ছেড়ে চলে যায়, তখন এর কারণ জানতে তিনি তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ্যাকাউন্টগুলো মোহগ্রস্তের মতো পর্যবেক্ষণ শুরু করেন।’ সে কেন আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল এ নিয়ে কখনোই ভাবনা বন্ধ করতে পারতাম না আমি,’ স্টিনা বলেন, ‘আর এর জন্য অনলাইনে প্রকাশিত তার নতুন সঙ্গীর সঙ্গে বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি দেখাই আমার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়।’ এটা একটা মোহ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর কয়েক বছর কেটে গেলেও এখনও সে তার ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক এবং টুইটার পেজ দেখে। ‘আমি প্রায়ই আমার সাবেক ছেলে বন্ধুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেখি এটা জানতে যে সে এখন কি করছে? এবং আমি এটাও দেখি যে নতুন করে কাদের সঙ্গে ডেট করছে সে আর তার নতুন সঙ্গীর এমন কি আছে যা আমার নেই।’ এ ধরনের সাইবার স্টকিং ধারণার চেয়েও অনেক বেশি। ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর ভেরোনিকা লুকাক্সের পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি ১০ জন সাবেক সঙ্গীর মধ্যে নয় জনই তাদের পুরনো সঙ্গীর ফেসবুক প্রোফাইল দেখে থাকে। সাইবার স্টকিং বেশ সহজ কারণ এতে আপনার সামনে আসার ভয় থাকে না কানাডার এই গবেষণাটি আরও প্রকাশ করে যে, ৭০ ভাগ মানুষ তাদের সাবেক সঙ্গীর প্রোফাইল তাদের মিউচুয়াল বন্ধুর এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেখে। এমনকি তারা যদি বন্ধু নাও থাকে কিংবা ব্লক করে দেয়া হলেও সাবেক সঙ্গীর এ্যাকাউন্ট দেখার কোন না কোন উপায় খুঁজে বের করে তারা। স্টিনা বলেন, তার সাবেক সঙ্গী ও তার নতুন সঙ্গীর ওপর নজর রাখতে একটি ফেক প্রোফাইল তৈরি করেছেন তিনি। যাতে তারা কখনও টের না পায়। ইউনিভার্সিটি অব বেডফোর্ড শায়ারের জাতীয় সাইবারস্টকিং গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক এবং মনোবিজ্ঞানী এমা শর্ট, বিশ্লেষণ করেছেন যে, কিভাবে অনলাইন স্পেস আমাদের সবকিছুর সঙ্গে জড়িত না হয়েও সবকিছু পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেয়। তবে এমন সুযোগ আমাদের ‘সীমানা’ সম্পর্কে সচেতন থাকার চেতনাকে দুর্বল করে দেয়। মানুষের সম্পর্কে নজর রাখা আসলে খারাপ কিছু নয়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের নজর রাখতে এত বেশি সুযোগ করে দেয়, যা করাটা উচিত নয় এবং যা অনেক সময় আমরা আসলে করতে চাইও না। কোন ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই এখন মোহগ্রস্ত আচরণ এমনভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব যা ভিন্ন পরিবেশ এলে মোহগ্রস্ত মনে হবে না। আপনি চাইলে আপনার সাবেক সঙ্গীর প্রোফাইল দিনে একশবার দেখতে পারেন। সঙ্গে আপনার দৈনন্দিন স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডও চালিয়ে যেতে পারবেন। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা, স্বাভাবিক আচরণ করা দেখলে মনে হবে যে আপনি আপনার খেয়াল রাখছেন...বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে না যে কোন সমস্যা আছে। কিন্তু আপনি যদি আপনার সাবেক সঙ্গীর অফিসের বাইরে গিয়ে হাজির হন এবং জানালা দিয়ে দিনে আট ঘণ্টা তার দিকে তাকিয়ে থাকেন তাহলে সেটি ভিন্ন বিষয়। আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ তথ্য রয়েছে আমাদের হাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অন্যের জীবনে আমাদের উঁকি মারার একটি জানালা খুলে দেয় এবং বিশাল তথ্য ভাণ্ডারে প্রবেশের সুযোগ করে দেয় যা আগে কখনো ছিল না। অনলাইনে আমরা যে তথ্য দেই- যখন কারও সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে চেক ইন দেই কিংবা কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর কথা জানাই তখন সেটা নতুন নতুন সূত্র ও সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করে। বিপরীতমুখী ঈর্ষার সমস্যা রয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সঙ্গীর অতীত জীবন নিয়ে জানার আগ্রহ অনেক বেশি হয়ে দেখা দিতে পারে। অতীতে, কারও সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানার তেমন কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন এটা বেশ সহজ। কমেডিয়ান অ্যানড্রিয়া হাবার্ট বলেন, তার যখন ২০ বছর বয়স ছিল, তখন তার সঙ্গী তাকে ছেড়ে যায়। তার সঙ্গে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে দেয় সে। এমনকি এমন আচরণ শুরু করে যে, তার জীবনে তার অস্তিত্বই কখনও ছিল না। তিনি জানতেন যে, তার সঙ্গী অন্য কারও সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর নিয়মিত তাকে অনলাইনে স্টক করা শুরু করেন তিনি। আর এটি তিনি বারবারই করতে লাগলেন।’ যখন আপনাকে বাধা দেয়ার কেউ নেই, তখন আপনি অন্যের প্রোফাইলে দিনে ৬০-৭০ বার দেখবেন, এ্যানড্রিয়া বলেন। ‘নিজের ক্ষতি করার অত্যন্ত সূক্ষ্ম মাধ্যম’ অনলাইনে কিছু দেখাকে আসলে নির্দিষ্টভাবে তেমন ক্ষতিকর মনে হয় না। কিন্তু ‘আসলে নিজের একটু একটু করে ক্ষতি করছেন আপনি। নিজের ক্ষতি করার অতি সূক্ষ্ম একটি মাধ্যম এটি।’ তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারজনিত আচরণ যে তার ভোগান্তিকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল তা তিনি বুঝতে পারতেন। আপনি যে দুঃখ অনুভব করছেন তা কমানোর জন্য স্থায়ী একটি সমাধান খুঁজবেন আপনি, কিন্তু আপনি যা খুঁজছেন তা কখনোই পাবেন না, তিনি বলেন, মনোবিজ্ঞানী এমা শর্ট সহমত দেন যে, যারা সাইবারস্টকিং বা মোহগ্রস্ত অনলাইন আচরণ করেন তাদের স্বাস্থ্যের ওপর এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এসব আচরণ ভুক্তভোগীদের একই ধরনের আচরণ বার বার করার দিকে ঠেলে দেয় যা আসলে তাদের জন্য কোন ফল বয়ে আনে না।’ আপনি কোন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাবেন না। আর সামাজিক জীব হিসেবে সেখানে আমাদের থাকা উচিত নয়, এমা বলেন। এছাড়াও, তিনি আরও বলেন, কোন কিছুর পেছনে এত শ্রম আর শক্তি ব্যয় করার পরও আপনি কোন প্রতিদান না পেলে তা আপনার ‘আত্মসম্মানও বাড়াবে না।’ এ ধরনের সমস্যায় করণীয় কি সম্প্রতি গবেষণাগুলো থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো, মানুষ যখন অনুভব করে যে তারা অনলাইনে অন্যের পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করছে বা তারা যদি তাদের আচরণ নিয়ে দোষী অনুভব করে তাহলে সে বিষয়ে তাদের কথা বলা উচিত। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলুন, এমা বলেন, ‘যারা মনে করেন যে, তাদের জীবন এতটাই প্রভাবিত হয়েছে যে তারা আটকে গেছেন বলে অনুভব করছেন তাদের জন্য পেশাদারদের সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। জ্যাক বলেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পুরো সমস্যাটাই আসলে তার সৃষ্টি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শুধু এটাকে আরও বেশি খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে... এটা থেকে বেরিয়ে আসার শুরুতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, শীঘ্রই আমাকে এগুলো ছেড়ে দিতে হবে। অনলাইনে তিনি কম সময় ব্যয় করতে শুরু করলেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি যাতে তার সাবেক সঙ্গীর বিষয়ে আগ্রহী না হন তা কঠোরভাবে অনুসরণ করা শুরু করেন। আপনাকে সেই লোভ সামলা বেশ কঠোর হতে হবে। তিনি বলেন, কারণ ওই লোভ সহসাই আপনাকে ছেড়ে যাবে না।’ আর অ্যানড্রিয়া বলেন, তিনি জানতেন যে, সামনে এগিয়ে যেতে হলে ভিন্ন পথে এগুতে হবে তাকে। সম্পর্ক ভাঙার পর অনলাইনে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। কারণ তিনি আবার মোহগ্রস্তদের মতো আচরণে অভ্যস্ত হতে চাননি। তিনি বলেন, ‘সমস্যাটি বুঝতে পারাই ছিল সবচেয়ে কঠিন।’ তারপর থেকে আর কোন সাবেক সঙ্গীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইল দেখেননি তিনি।
×