
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক শব্দগুলোর একটি পি.আর. (PR) বা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন সিস্টেম। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় থেকে এই পদ্ধতিটি নিয়ে রাজনৈতিক, একাডেমিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই এটিকে গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির নতুন পথ হিসেবে দেখছেন, আবার অনেকে এটিকে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার এক নব রূপ বলে সতর্ক করছেন। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের বিদ্যমান একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ভর সংসদীয় নির্বাচনী ব্যবস্থা বা FPTP (First-Past-the-Post) পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে PR কতটা বাস্তবসম্মত? আমাদের আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কাঠামো কি এই পদ্ধতির উপযোগিতা ধারণ করতে প্রস্তুত?
পি.আর. পদ্ধতি কী?
PR বা Proportional Representation হলো এমন এক নির্বাচনী পদ্ধতি, যেখানে একটি দল বা প্রার্থী যে পরিমাণ ভোট পায়, সে অনুপাতে সংসদ বা আইনসভায় আসন পায়। এ পদ্ধতির মূল ধারণা—"ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন"। অর্থাৎ ২০% ভোট পেলে দলটি ২০% আসন পাবে, তা সে একটি আসনেও সরাসরি বিজয়ী হোক বা না হোক। এই পদ্ধতিতে সাধারণত মাল্টি-মেম্বার কনস্টিটুয়েন্সি ও দলভিত্তিক ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন-এর ধারণার উদ্ভব হয় ১৮৩০-এর দশকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে, যখন সমাজে ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের পর্যাপ্ত রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব না পাওয়ার বিরুদ্ধে একধরনের আন্দোলন শুরু হয়। ১৮৯৯ সালে আধুনিকভাবে প্রথমবারের মতো PR পদ্ধতি চালু করে বেলজিয়াম। পরে এটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা ছিল জরুরি।
বর্তমানে কোন কোন দেশে PR আছে:
PR পদ্ধতি বর্তমানে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, ইসরায়েল, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, নেপাল প্রভৃতি দেশে চালু রয়েছে। তবে একেক দেশ একে একেকভাবে বাস্তবায়ন করে—মিশ্র (Mixed), খোলা তালিকা (Open List), বন্ধ তালিকা (Closed List), অথবা জার্মানির মতো MMP (Mixed Member Proportional) পদ্ধতিতে।
পি.আর. পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো:
-
ভোটের হার অনুযায়ী আসন বণ্টন হয়
-
মাল্টি-মেম্বার কনস্টিটুয়েন্সি থাকে
-
দলভিত্তিক তালিকা ভোটাররা বেছে নেয়
-
ছোট দলগুলোও সুযোগ পায় সংসদে প্রবেশের
-
ভোটার ও প্রার্থীর সরাসরি সম্পর্ক তুলনামূলক দুর্বল হয়
পি.আর. পদ্ধতির সুবিধা:
১. ভোটের প্রতিফলন নিশ্চিত হয় – কোনো ভোট “নষ্ট” হয় না
২. সংখ্যালঘু, ধর্মীয় বা আঞ্চলিক দলগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ে
৩. ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ কমে, আলোচনা ও সমঝোতা ভিত্তিক শাসন হয়
৪. রাজনৈতিক বৈচিত্র্য উঠে আসে, একক দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ কমে যায়
৫. নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নির্বাচন সহজ হয়
পি.আর. পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ:
১. দুর্বল ও জটিল কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়, যা কার্যকারিতা কমায়
২. নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়, বা কোনো সিদ্ধান্তই হয় না
৩. উগ্র, বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীও বৈধতা পায় সংসদে, রাষ্ট্রের ঐক্য প্রশ্নের মুখে পড়ে
৪. নেতা ও জনতার সরাসরি সম্পর্ক থাকে না, দলই সব সিদ্ধান্ত নেয়
৫. রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে, ঘনঘন সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা
পিআর পদ্ধতি গ্রহণকারী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কেমন:
জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জার্মানি "মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতি" (মিশ্র PR ও সরাসরি নির্বাচন) গ্রহণ করে। এই পদ্ধতির ফলে দেশটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করে এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ বা চরমপন্থার উত্থান কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। এতে করে গণতন্ত্রের ভিত্তি আরও মজবুত হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায়, আপারথেইড-পরবর্তী যুগে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক কাঠামো গঠনের লক্ষ্যে PR পদ্ধতি গ্রহণ করে। এর ফলে বিভিন্ন বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষ রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব লাভ করে।
নেদারল্যান্ডস ও সুইডেনে এই দুটি দেশেই PR পদ্ধতি বহুদিন ধরে কার্যকরভাবে চালু আছে। এর ফলে বহুদলীয় সরকার গঠন হয়, যারা সাধারণত সমাজকল্যাণমূলক নীতির দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। ফলে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার উন্নত মান বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।
ইসরায়েলে PR পদ্ধতির ফলে প্রায়শই ছোট ছোট দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, ফলে সরকার গঠনে জোট নির্ভরতা বাড়ে। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ইসরায়েলে পাঁচবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নেপালে PR ব্যবস্থা চালুর পর জাতিগত ও আঞ্চলিক ভিত্তিক ছোট ছোট দলগুলোর উত্থান ঘটে। যদিও এটি বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে, তবে এর ফলে প্রায়শই কোয়ালিশন জটিলতা, সরকার গঠনে দীর্ঘসূত্রতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। জাতিগত বিভাজন ও দলীয় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে।
বড় দল PR চায় না, ছোট দল চায় কেন?
বড় দলগুলোর PR না চাওয়ার অন্যতম কারণ তারা FPTP-তে কম ভোট পেয়েও অনেক আসন পায়। PR চালু হলে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে। অন্যদিকে ছোট দলগুলো PR চায় কারণ PR পদ্ধতিতে তাদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব সংসদে নিশ্চিত হয়, এমনকি ৫%-৭% ভোট পেলেও আসন পেতে পারে। ফলে তারা "কিংমেকার" হয়ে উঠতে পারে, জোট সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর: সম্ভাবনা না সংকট?
বাংলাদেশ একটি একক ও কেন্দ্রিক রাষ্ট্র (Unitary State), এখানে সমাজ কাঠামো তুলনামূলকভাবে অভিন্ন। ফলে PR পদ্ধতি আঞ্চলিকতা, ধর্মীয় মেরুকরণ, এবং বিদেশি প্রভাবিত গোষ্ঠীর উত্থান ঘটাতে পারে। রাজনীতিতে দলীয় শৃঙ্খলা দুর্বল এবং নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন—সবকিছুই কাঠামোগত দুর্বলতায় জর্জরিত। ফলে PR ব্যবস্থায় এক ধরনের ‘রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা’ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
PR পদ্ধতি চালু হলে ভারত কি কোনো বাড়তি সুবিধা পাবে?
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা প্রকার কূটনৈতিক ও গোপন প্রভাব রেখেছে ভারত। PR ব্যবস্থায় ছোট ছোট দল সংসদে ঢুকে পড়লে, সেখানে ভারত-সমর্থিত বা ভারতপন্থী দলও সংসদে আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। এছাড়া, সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কোনো সংগঠন PR ব্যবস্থায় সংগঠিত হয়ে সংসদে ঢুকলে সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় চরম হুমকি তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশে PR নিয়ে আলোচনা হঠাৎ এত বেড়ে গেল কেন?
২০২৫ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের প্রতীকী পুনর্জাগরণ। সেই প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক কাঠামোর দাবি তোলে। এর মধ্যেই PR পদ্ধতিকে “অন্তর্ভুক্তির একটি সম্ভাব্য পথ” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, “সংসদে আসন দিলেই গণতন্ত্র হয় না।” যদি সেই অংশগ্রহণ রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে, তাহলে সেটা কোনো সমাধান নয়, বরং বড় সংকট।
কী হতে পারে সম্ভাব্য সমাধান?
বাংলাদেশের মতো দেশে হঠাৎ করে পূর্ণাঙ্গ PR ব্যবস্থা চালু না করে ধাপে ধাপে, কাঠামোগত প্রস্তুতির মাধ্যমে পদ্ধতিটি বাস্তবায়ন করা বাঞ্ছনীয়। এজন্য কয়েকটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
-
উচ্চকক্ষে PR পদ্ধতি চালু: ভবিষ্যতে যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠিত হয়, তবে প্রথম ধাপে উচ্চকক্ষে PR পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে সকল শ্রেণি-পেশা ও গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে।
-
নিম্নকক্ষে FPTP পদ্ধতি বজায় রাখা: বর্তমানে বিদ্যমান সরাসরি ভোটে বিজয়ী হওয়ার পদ্ধতি (FPTP) নিম্নকক্ষে অস্থায়ীভাবে বজায় রাখা যেতে পারে, যাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
-
দশ বছর পর মূল্যায়ন: এক দশক পরে এই পদ্ধতির ফলাফল পর্যালোচনার মাধ্যমে পূর্ণ PR ব্যবস্থায় যাওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করা যেতে পারে।
-
গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী করা: শুধু নির্বাচনী পদ্ধতি বদল নয়, বরং গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, জবাবদিহিতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, এবং নাগরিক সচেতনতা। এসব ছাড়া শুধু পদ্ধতির পরিবর্তন এক নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।
পি.আর. পদ্ধতি নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির একটি সম্ভাব্য পথ, তবে এর সাফল্য নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক সাংবিধানিক প্রস্তুতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার উপর।
মুমু ২