ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

৯ সাংগঠনিক বিভাগে পৃথক ৯ কমিটি

জাতীয় কাউন্সিল সামনে রেখে দল পুনর্গঠন করছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:২০, ২৯ নভেম্বর ২০২৪

জাতীয় কাউন্সিল সামনে রেখে দল পুনর্গঠন করছে বিএনপি

জাতীয় কাউন্সিলকে টার্গেট করে সারা দেশের সর্বস্তরে দল পুনর্গঠন বিএনপি

জাতীয় কাউন্সিলকে টার্গেট করে সারা দেশের সর্বস্তরে দল পুনর্গঠন করছে বিএনপি। দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশ অনুসারে আসছে নতুন বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে সারা দেশের ইউনিয়ন, পৌরসভা, থানা, উপজেলা, জেলা ও মহানগর কমিটি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর এ পুনর্গঠন কাজ সফল করতে সিনিয়র নেতাদের নিয়ে ঢাকা ছাড়া ৯ সাংগঠনিক বিভাগের জন্য ৯টি পৃথক কমিটি করা হয়েছে। আর এই কমিটিগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।  
সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা পেয়ে সর্বস্তরে কমিটি পুনর্গঠন করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। ডিসেম্বরের শুরু থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন পর্যন্ত দল পুনর্গঠন কাজ চলবে। এরপর সারা দেশের সকল ইউনিট থেকে কাউন্সিলর চূড়ান্ত করে সকল কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে সুবিধাজনক সময়ে অনুষ্ঠিত হবে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল। 
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানায়, পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় দীর্ঘ পৌনে ৯ বছর দলটির জাতীয় কাউন্সিল হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর পরিস্থিতি অনুকূলে আসায় নতুন উদ্যমে দলের জাতীয় কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর এ কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা এখন অধিক সক্রিয়। তাই দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন চাঙ্গা। তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠনের পর কাউন্সিলরদের নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে এবার দলের জাতীয় কাউন্সিল হবে। তাই সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় কাউন্সিলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। 
বিএনপির কমিটি পুনর্গঠনের কাজ তদারকি করতে দলের ৯ সিনিয়র নেতাকে দেওয়া হয়েছে ৯ সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্ব। তবে ঢাকা বিভাগের দায়িত্ব এখনো সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে দেওয়া হয়নি। যে ৯ বিভাগে সিনিয়র নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সিলেট বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনকে, চট্টগ্রাম বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানকে, রাজশাহী বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালামকে, বরিশাল বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, রংপুর বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, কুমিল্লা বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু, ময়মনসিংহ বিভাগে যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, খুলনা বিভাগে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, ও ফরিদপুর বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপনকে।
সূত্র মতে, ৯ বিভাগে দল পুনর্গঠন কার্যক্রমের দায়িত্ব পাওয়া নেতারা ইতোমধ্যে কার্যক্রমও শুরু করেছেন। ডিসেম্বরের শুরুতেই তারা বিভিন্ন এলাকা সফরে যাবেন। ৮২ সাংগঠনিক জেলাসহ তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন এমন ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে। 
সূত্র জানায়, বর্তমানে সারাদেশের সকল ইউনিটের মধ্যে অধিকাংশ ইউনিটেই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। আর যেসব ইউনিটে কমিটি আছে সেগুলোর অধিকাংশই আহ্বায়ক কমিটি। কোনো কোনো ইউনিটে কমিটিই নেই। তাই এবার জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে সবখানে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হবে।   
দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, অনেক নেতাকর্মী কারাবন্দি হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় বিগত পৌনে ৯ বছরেও বিএনপি জাতীয় জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হাইকমান্ডের নির্দেশনা পেয়ে নতুন উদ্যমে জাতীয় কাউন্সিলের জন্য দলের নেতাকর্মীরা তৎপর হয়। যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় কাউন্সিল ও নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের বিষয়ে দলের অভ্যন্তরে চাপও বৃদ্ধি পায়। 
তাই ৩ মাসের মধ্যে অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে সর্বস্তরে দল পুনর্গঠনের কাজ শেষ করে জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি জোরদার করা হচ্ছে। জাতীয় কাউন্সিল করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সর্বস্তরে দলকে গতিশীল করতে চায় দলীয় হাইকমান্ড।  
৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে জাতীয় কাউন্সিলের দাবি জোরদার হয়। এ পরিস্থিতিতে দলের সিনিয়র নেতারা কাউন্সিলের প্রস্তুতি শুরু করেন। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ থাকায় এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থাকায় এবং সারা দেশের বিভিন্ন স্তরে কমিটিগুলো মেয়াদউত্তীর্ণ থাকায় জাতীয় কাউন্সিলের জন্য কিছু সময় নেওয়া হয়। 
জাতীয় কাউন্সিল না হওয়ায় এখনো পৌনে ৯ বছর আগে  করা কমিটি দিয়েই চলছে বিএনপি। ৫৯২ সদস্যের পুরনো কমিটিতে শূন্যপদ রয়েছে অর্ধশতাধিক। এ ছাড়া এ কমিটির শতাধিক নেতা দলে নিষ্ক্রিয়। জাতীয় কাউন্সিল হলে নতুন কমিটির বিভিন্ন পদে স্থান পাওয়ার সুযোগ পাবেন দেড় শতাধিক নেতা। তাই কাউন্সিল না হওয়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির পদপ্রত্যাশীরা কিছুটা হতাশ। এ পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে দলের বেশ ক’জন নেতাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। তবে জাতীয় কাউন্সিলের পর যোগ্য সবাইকে নিয়েই নির্বাহী কমিটি করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। 
দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে তিন বছর পরপর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করে নতুন কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বিএনপি বিভিন্ন কারণে তা করতে পারেনি। এ কারণে দলের পদপ্রত্যাশী অনেক নেতাকর্মী হাইকমান্ডের প্রতি কিছুটা নাখোশ হলেও পরিস্থিতির কারণে তারা আবার সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন। তাই হাইকমান্ডের নির্দেশ মেনেই দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা নিয়মিত দলীয় সকল কর্মকা- চালিয়ে গেছেন। অনেকে জাতীয় কাউন্সিলর পর পরবর্তী কমিটিতে স্থান পেতে এখন থেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। 
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় । 
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেশ ক’দফা জাতীয় কাউন্সিল করার কথা দলের বিভিন্ন স্তর থেকে জোরেশোরে উচ্চারিত হলেও পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় শেষ পর্যন্ত তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এর পর ২০২০ সালে দেশে ভয়াবহ করোনা শুরু হলে নির্বাচন কমিশন থেকে জাতীয় কাউন্সিল করতে সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়। তবে দেশে করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে জাতীয় কাউন্সিল করবে বলে জানালেও পরে সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় তখন জাতীয় কাউন্সিল করেনি বিএনপি। এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকেও অবহিত করে তারা। কারণ, কোনো কারণে ৩ বছরের মধ্যে জাতীয় কাউন্সিল না করতে পারলে তা নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করতে হয়। 
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হওয়ার আগে দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সর্বস্তরে দল গুছিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলকে ঢেলে সাজাতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় কাউন্সিলের দাবি তুললেও পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় এ বিষয়ে লন্ডনপ্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সায় ছিল না।

সে কারণে তখন জাতীয় কাউন্সিল করেনি বিএনপি। এরপর আরও কয়েক দফা দলের সিনিয়র নেতারা জাতীয় কাউন্সিলের দাবিতে সোচ্চার হন। বর্তমানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে থাকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে ইতবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানা যায়। 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, সারা দেশের সর্বস্তরে দল পুনর্গঠন করার কাজ শুরু হচ্ছে। সকল পর্যায়ে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করে কাউন্সিলরদের তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। এরপর দলীয় হাইকমান্ডের অনুমতি নিয়ে জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হবে।

×