.
জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়েছেন। দলে কর্তৃত্ব হারিয়ে অনেকটা ‘একঘরে’ হয়ে পড়েছেন তারা। বলতে গেলে রওশন এরশাদ দুই কূলই হারালেন। রাজনীতির খেলায় রওশন এরশাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে গেছে। এবার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক অধ্যায়ের শেষ হতে যাচ্ছে। রাজনীতির খেলায় জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের কাছে হেরে গেছেন রওশন এরশাদ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কার্যত তিনি মাইনাস হয়ে গেছেন। এরপর জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদটিও হারাতে পারেন।
দীর্ঘ ৩২ বছর পর নির্বাচনে নেই জাপার ৮২ বছর বয়সী প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। শুধু রওশন একা নন, নির্বাচনে নেই দলের প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও রওশনের ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদও। সাদ যে আসনের সংসদ সদস্য, সেখানে আবার এরশাদের ভাই, দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়।
আগামী ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাপা অংশ নিচ্ছে। দলটির নেতারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। জাপা ৫০টি আসন দাবি করলেও ৩০টির বেশি আসন দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কয়েকদিনের মধ্যে জানা যাবে।
জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও তার ছেলে সাদ এরশাদ ছাড়া নির্বাচন দলটির নেতাকর্মীরা কতটুকু গ্রহণ করবে তা দেখার বিষয়। এর আগে রওশন এরশাদ সাংবাদিকদের বলেন, আমার বয়স হয়েছে তাই নির্বাচন করছি না। অন্য কোনো কারণ নয়। আর ছেলে সাদ এরশাদের ভাগ্যে নেই, তাই নির্বাচন করতে পারেনি। আমার সঙ্গে যারা আছে, তাদের জিএম কাদের পার্টিতে ফিরিয়ে নেয়নি।
মনোনয়ন দ্বন্দ্বের সমাধান না হলে গত ২৯ নভেম্বর সাংবাদিকদের রওশন এরশাদ বলেন, আমি দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। এবারও তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছি। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু সহযোগিতা না করায় দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন রওশন। তিনি বলেন, এমন অবস্থায় দলের নেতাদের অবমূল্যায়ন করার কারণে আমার নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ আর বয়স, বার্ধক্য ও অসুস্থতার কারণে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। রওশন এরশাদের বয়স এখন ৮২ বছর। দীর্ঘ ৩২ বছর দোর্দ- প্রতাপের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। বর্তমানে রাজনীতি করার সেই অবস্থাও নেই। সব মিলিয়ে রাজনীতি, দল থেকে তিনি ছিটকে পড়লেন। দ্বাদশ সংসদের নির্বাচনী ট্রেনে তিনি চড়তে পারলেন না।
জাপা সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভরসায় ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। বারবার চেষ্টাতেও সরকারপ্রধানের সাক্ষাৎ না পাওয়ায় রওশনের ক্ষমতা হ্রাস পায়। রওশন এরশাদের নির্বাচনী মাঠ থেকে দূরে থাকার বিষয়টি অনেকেই ভাবতে পারেননি। আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় রওশনপন্থিদের মধ্যে হতাশার ছাপ পড়েছে। তার অনুসারীদেরও রাজনীতির ময়দান থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের মৃত্যুর পর জাপায় কোন্দল বেড়ে যায়। এক অংশের নেতৃত্ব দেন বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের, অন্য অংশের নেতৃত্বে ছিলেন রওশন এরশাদ। দীর্ঘদিন ধরে জাপায় দুটি ধারা চলে আসছিল। এবার রওশন এরশাদ নির্বাচনে না আসায় জিএম কাদের এককভাবে জাপার নেতৃত্বে।
জাপার একটি সূত্র জানায়, এবার নির্বাচনে অংশ নিলে রওশনই জয়ী হতেন। স্বামীর মতো তিনিও এমপি অবস্থায় জীবনের শেষ সময় কাটাতে পারতেন। কিন্তু ছেলের পাল্লায় পড়ে সেটি আর হলো না।
রওশন এরশাদ বর্তমানে একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৪১ সালের ১৯ জুলাই রওশন এরশাদ জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী, যার সঙ্গে তিনি ১৯৫৬ সালে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন রওশন এরশাদ সমাজকল্যাণ ও নারী-শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনি ‘বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা সংস্থা’র প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ‘সেনা পরিবার কল্যাণ সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৯৮৫ সালের মে মাসে তিনি বন্যাকবলিত নোয়াখালীর উড়িরচর ও হাতিয়া উপজেলা এলাকা পরিদর্শন করেন। একই বছর তিনি মাদকের অপব্যবহার সংক্রান্ত জাতিসংঘের বিশেষ কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেন। তার ব্যক্তিগত আগ্রহের মাঝে রয়েছে সাহিত্য, এশীয় সংগীত ও শিল্পকলা।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রওশনের নেতৃত্বে জাপার অংশগ্রহণকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তিনিই প্রথম স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় কোন্দলের কারণে এবার নির্বাচনে অংশ নেওয়া হলো না তার। জাপার চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে দায়ী করে রওশন এরশাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। রওশন এরশাদ ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয়বারের সংসদ সদস্য। এর মধ্যে ২০০৮ সালে তিনি ভোটে হেরে যাওয়ার পর উপনির্বাচনে এরশাদের ছেড়ে দেওয়া রংপুর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদ আমৃত্যু এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১৮ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে সাদ এরশাদ সংসদ সদস্য হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রওশনপন্থি এক নেতা বলেন, আমরা জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর কৌশলের কাছে পরাজিত। তারা কৌশলে রওশনপন্থি বলে পরিচিতদের দল থেকে বের করে দিয়েছেন। এখন রওশন এরশাদ দলের কোনো ক্ষমতা রাখেন না। মূলত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও জাপার সমর্থন হারিয়ে নির্বাচন থেকে ছিটকে গেলেন রওশন এরশাদ। ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদের কারণে দলের সিনিয়র নেতাদের সমর্থন হারান। আর নির্বাচনে আনতে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার সঙ্গে সরকারের সমঝোতার কারণে ক্ষমতাসীনদের পাশে পাননি রওশন এরশাদ। ফলে তিনি দুই কূলই হারিয়েছেন। অসুস্থতা ও বয়সের কারণে রওশন এরশাদ ফের রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন, তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
তবে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও তার পুত্র সাদ এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও তার বেশ কয়েকজন অনুসারী স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন। আবার কেউ অন্য দলের ব্যানারে নির্বাচন করছেন।
সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। রওশনপন্থি নেতা ময়মনসিংহ জেলা জাপার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কেআর ইসলাম ময়মনসিংহ-৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসন থেকে রুস্তম আলী ফরাজী স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন। সবচেয়ে বেশি প্রার্থী দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) থেকে। সাবেক এমপি জাফর ইকবাল সিদ্দিকী নীলফামারী-১ আসনে নোঙ্গর প্রতীকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ক্বারী হাবিবুল্লাহ বেলালী ময়মনসিংহ-১০ আসনে বিএনএমের প্রার্থী হয়েছেন। ইঞ্জিনিয়ার মামুনুর রশীদ জাপার মনোনয়ন না পেয়ে বিএনএম থেকে জামালপুর-৪ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। শাহজামাল রানা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ এবং মঞ্জুরুল হক সাচ্চা গাইবান্ধা-৩ আসনে বিএনএম থেকে প্রার্থী হয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া এরশাদের ঘনিষ্ঠ সাবেক প্রতিমন্ত্রী গোলাম সারওয়ার মিলন, সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, এসএমএম আলম, সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ্, সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদ, সাবেক ছাত্রনেতা ও যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজুসহ অনেকেই নির্বাচনে অংশ নেননি বলে জানা গেছে।