ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজপথে শক্তির মহড়া দিতে চায় দলটি

১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি বিএনপির

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ১৬ নভেম্বর ২০২২

১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি বিএনপির

১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি

১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এ জন্য দিন-রাত দৌড়ঝাঁপ করছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন টার্গেট করে সারাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটিয়ে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের মহড়া দিতে চায়। এটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন জোরদারের কৌশল। আর মহাসমাবেশ থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে সরকারকে আলটিমেটাম দেবে। তাই এই মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারাদেশের সর্বস্তরের বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। সাধারণ মানুষের মনেও প্রশ্ন কি হচ্ছে ১০ ডিসেম্বর?
বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। আর মহাসমাবেশ সামনে রেখে বিএনপির সিনিয়র নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কেউ বলছেন ওই দিনই হবে এ সরকারের শেষ দিন, কেউ বলছেন ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে, কেউ কেউ বলছেন ১০ ডিসেম্বরের কথা শুনে আওয়ামী লীগ ভয় পাচ্ছে। আর এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলছেন, ১০ ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপি ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছে, বাস্তবে ওই মহাসমাবেশের মাধ্যমে তারা কিছুই করতে পারবে না। আর এ কর্মসূচির নামে রাজপথে বিশৃংখলার চেষ্টা করলে রাজনৈতিকভাবেই তাদের প্রতিহত করা হবে। আইনশৃংখলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বলা হয়েছে, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের বিশৃংখলা করতে দেওয়া হবে না।
প্রায় দেড় দশক ধরে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজা নিয়ে কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে দলীয় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে। তার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তাই তিনি দেশে ফিরে আসার ঝুঁকি নিচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকা দলটির হাইকমান্ড চাচ্ছে দ্বাদশ নির্বাচনের আগেই অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে নির্বাচনে অংশ নিতে। তাই নির্বাচনের এক বছর আগে রাজধানীতে একটি বড় ধরনের শোডাউন করে সরকার বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চায়। রাজপথে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করে আন্দোলনে কিছু দাবি আদায় করে জাতীয় নির্বাচনে সুবিধা আদায় করতে চায়।
সূত্র জানায়, ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকার সকল ইউনিটসহ সারাদেশের সকল স্তরে বিএনপি নেতাকর্মীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রস্তুতি জোরদার করছে। কিভাবে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক নিয়ে নিজ নিজ এলাকা থেকে মহাসমাবেশে উপস্থিত থাকা যায় সেই পরিকল্পনা করে প্রস্তুতি জোরদার করছে তারা। এ জন্য দলটির সর্বস্তরে প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দেশের বাইরে থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সারাদেশের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলছেন। সিনিয়র নেতারাও মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তবে মহাসমাবেশে আসতে যেন তারা বাধার সম্মুখীন না হন সে জন্য তারা পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন।
১০ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে অতি সম্প্রীতি ডিএমপি কমিশনারকে চিঠি দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এ সময় তারা মহাসমাবেশে আসার পথে নেতাকর্মীরা যেন কোনো বাধার সম্মুখীন না হন সে জন্য পুলিশের সহযোগিতা চান। আর ডিএমপির পক্ষ থেকে বিএনপি নেতাদের জানানো হয় গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। বিএনপির এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের ঝুঁকি রয়েছে কিনা তা দেখা হবে।
মহাসমাবেশের অনুমতি পেতে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে চিঠি নিয়ে যান দলটির ৭ নেতা যথাক্রমে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু। পরে আমানউল্লাহ আমান সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের অনুমতি চেয়ে ডিএমপিতে চিঠি দিয়েছি।

নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছি। মহাসমাবেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের আসতে যাতে বাধা দেওয়া না হয় সে বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারকে জানিয়েছি। আমরা বলেছি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ হবে, কোনো ধরনের বিশৃংখলা হবে না। তারা বলেছেন, আলোচনা করে পরে আমাদের জানাবেন। পুলিশ নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবে। আমাদের আগের বিভাগীয় গণসমাবেশের সময় সব গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই আমরা বলেছি, এভাবে পরিবহন বন্ধ করা যাবে না। আমাদের সমাবেশে যারা আসবে তাদের যেন বাধা না দেওয়া হয় এবং তাদের ওপর যেন কোনো আক্রমণ না করা হয়। ডিএমপি কমিশনারকে বলেছি, আপনি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কমিশনার নন। আপনি সরকারি কর্মকর্তা, আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করবেন।
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক জানান, রাজধানীতে মহাসমাবেশ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ করতে চাই। তাই আমরা চাই না এই সমাবেশের আগে সরকার বা আওয়ামী লীগ বাধা সৃষ্টি করুক বা কোনো ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করুক।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজপথে শক্তি প্রদর্শন করে সরকারকে চাপে ফেলে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে চায় বিএনপি।

এরই অংশ হিসেবে ১২ অক্টোবর থেকে ১০ বিভাগীয় সদরে সমাবেশ কর্মসূচি পালন শুরু করে বিএনপি। প্রতিটি সমাবেশেই বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সর্বস্তরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে ব্যাপক লোকসমাগম করতে চায়। ২০০১ সালের আগে যেভাবে রাজপথ দখলে রেখে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে সেভাবে আন্দোলন করতে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। তাই মহাসমাবেশ থেকে আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করতে চায় বিএনপি।
নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুসারে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তফসিল ও ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই এ নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখেই বিএনপি নিজেদের দলীয় শক্তি বৃদ্ধি করে আন্দোলন জোরদার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালের মতো আবারও কঠোর কোন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়তে চায় না বিএনপি। তাই সেভাবেই আন্দোলনের রূপরেখা ঠিক করা হচ্ছে। এ কারণে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতকেও কৌশলে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। তারপরও বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে বিএনপি ১০ ডিসেম্বর কোন বিশৃংখলা করে কিনা।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ১০ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করা হবে। এ জন্য দলের পক্ষ থেকে আমরা সবার সহযোগিতা চাই। দেশের মানুষ ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এ জন্যই বিএনপির আন্দোলনের প্রতি তারা সাড়া দিচ্ছে। ১০ ডিসেম্বরের কর্মসূচি সফল করতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। আশা করছি অন্যান্য বিভাগের মতো রাজধানী ঢাকার সমাবেশ সফল করার মধ্য দিয়ে সরকারকে আমরা বার্তা দিতে পারবো অবিলম্বে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিন। তা না হলে দুর্বার আন্দোলনে এ সরকারের পতন হবে।
উল্লেখ্য, রাজপথের আন্দোলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জুলাই মাস থেকেই ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শুরু করে বিএনপি। আর ১২ অক্টোবর থেকে নতুন উদ্যমে ১০ বিভাগে গণ-সমাবেশ কর্মসূচি পালন করছে। প্রথম গণ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে। দীর্ঘদিন পর এই গণ-সমাবেশে বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটায় দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়।

এরপর ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহের গণ-সমাবেশ কর্মসূচিতেও বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থকের উপস্থিতি ঘটে। এরপর ২২ অক্টোবর খুলনা, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুরের সমাবেশও ব্যাপক লোকসমাগম হয়। এরপর ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীর সমাবেশ শেষে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে বিএনপি।
গত জুলাই মাস থেকে প্রথমে রাজধানী কেন্দ্রিক ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করলেও ২২ আগস্ট থেকে সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে কর্মসূচি পালন শুরু করে বিএনপি। যেভাবে তারা ২০১৩ সালের কঠোর আন্দোলনের আগে তৃণমূল পর্যায়ে কর্মসূচি পালন জোরদার করেছিল এবারও সেভাবেই তৃণমূল থেকে আন্দোলন জোরদারের কৌশল নেয় দলটি। ওই বছর ২৯ ডিসেম্বর যেভাবে সারাদেশ থেকে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ঢাকায় জড়ো করতে ‘রোড ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল একইভাবে এবারও ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীদের জড়ো করতে চাচ্ছে।

আর এ কর্মসূচিকে সামনে রেখে প্রতিদিনই বিএনপির সিনিয়র নেতারা আন্দোলনে সরকার পতনের হুমকী দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও বিএনপিকে পাল্টা হুমকী দিয়ে কথা বলছেন। এর প্রভাব পড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তৃনমূল পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে। এ কারণেই এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। এর ফলে রাজপথও উত্তপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সূত্র জানায়, ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশ সফল করতে কেন্দ্রীয়ভাবে দলের সিনিয়র নেতারা দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির প্রতিটি ইউনিট প্রস্তুতি সভা করছে। এ ছাড়া ঢাকা বিভাগের ১১টি সাংগঠনিক জেলা ও এসব জেলা সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোতেও বিএনপি প্রস্তুতি সভা করছে। এর বাইরে সারাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায়ও স্থানীয় বিএনপি নেতারা কিভাবে ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে এসে মহাসমাবেশে যোগ দিতে পারে সে বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

×