
ছবি: সংগৃহীত।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের প্রচার ও রক্ষায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন (United Nations Human Rights Commission - UNHRC) এক অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও মানবিক বিপর্যয়ের পর ১৯৪৮ সালে যখন জাতিসংঘ "সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র" (UDHR) গ্রহণ করে, তখন থেকেই আন্তর্জাতিক পরিসরে মানবাধিকার রক্ষায় একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর ভিত্তি স্থাপিত হয়।
এরই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়, যা পরবর্তীকালে পুনর্গঠনের মাধ্যমে ‘মানবাধিকার কাউন্সিল’ নামে পরিচিতি পায় ২০০৬ সালে।
কমিশনের মূল কাজ হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যাচাই, সুপারিশ প্রদান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠায় সহায়তা প্রদান।
এটি রাষ্ট্র, সংস্থা ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান পরিচালনা করে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদন উপস্থাপন করে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যকারিতা মূল্যায়নের সময় একাধিক জটিল বাস্তবতা সামনে আসে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, আইনের শাসনের অভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং নাগরিক সমাজের দুর্বলতা মানবাধিকার সুরক্ষার পথে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
এসব দেশে মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ এবং রিপোর্ট কখনো কখনো ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। তবে এটি এই প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা এবং কার্যকারিতার প্রমাণও বটে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানবাধিকার সচেতনতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সক্ষম করে তোলা, নাগরিক সমাজকে অধিকতর সক্রিয় করে তোলা এবং আইনি কাঠামোর উন্নয়নে কমিশন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে।
বিশেষত, নারী ও শিশু অধিকার, বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারের প্রশ্নে এই কমিশনের নজরদারি ও হস্তক্ষেপ উন্নয়নশীল দেশের জন্য এক ধরনের আন্তর্জাতিক সুরক্ষার ছায়া হয়ে উঠেছে।
তবে বাস্তবতায় কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়ে গেছে। অনেক সময় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রমকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয় বলে সমালোচনা করা হয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোগ করে যে, মানবাধিকার ইস্যুতে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে কখনো কখনো তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা হয়, যা সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়।
আবার কিছু ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ ও প্রতিবেদনগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত হয়। তদুপরি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে কমিশনের সীমিত ক্ষমতা এর কার্যকারিতা হ্রাস করে।
এরপরও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চর্চার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত। এই কমিশনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, যা একধরনের চাপ হিসেবে কাজ করে এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ করে তোলে।
অনেক উন্নয়নশীল দেশই এখন জাতিসংঘের মানবাধিকার ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বিভিন্ন চুক্তি ও কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে, যা তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ আইনি কাঠামোকে আধুনিক এবং মানবাধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে উৎসাহিত করছে।
আবার, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল বিভিন্ন "বিশেষ প্রতিবেদনকারী" এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট দেশ বা বিষয়ের ওপর নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণমূলক কাজ করে থাকে। এসব প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে আসে, তা গবেষণা, প্রচার এবং মানবাধিকার আইনগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়া কাউন্সিলের "Universal Periodic Review - UPR" প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয় নিয়মিত, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি নিরপেক্ষ ও কাঠামোবদ্ধ মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি করে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন আন্তর্জাতিক সাহায্য ও উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসেবেও কাজ করে। অনেক দাতা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কোনো দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়েই অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করে।
ফলে মানবাধিকার রক্ষায় এই কমিশনের প্রতিবেদন অনেক সময় পরোক্ষভাবে নীতি প্রণয়ন ও বাজেট নির্ধারণেও প্রভাব ফেলে।
সবশেষে বলতে হয়, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন একদিকে যেমন বৈশ্বিক মানবাধিকার রক্ষায় একটি প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, তেমনি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি একটি নিরপেক্ষ তদারকি ও সচেতনতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
যদিও এর কার্যকারিতা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ, তবুও এর উপস্থিতি ও কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চর্চাকে আরো শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং সর্বজনীন করে তুলছে।
ভবিষ্যতে যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন এবং প্রযুক্তিনির্ভর একটি কার্যকর কাঠামোর মধ্য দিয়ে এই কমিশন কাজ করতে পারে, তবে এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও বৃহত্তর সহায়ক শক্তি হয়ে উঠবে মানবাধিকারের এক সত্যিকারের আশ্রয় হয়ে।
লেখক: ইরফান ইবনে আমিন পাটোয়ারী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
মিরাজ খান