
সিডনির মেলব্যাগ
প্রবাসে বাংলাদেশিদের অবস্থান পোক্ত হয়ে গেছে। আমাদের দেশের জন্মলগ্ন থেকেই মনুষ দেশান্তরী হতে শুরু করে এখন অভিবাসন একটি নিয়মিত বিষয়ে পৌঁছে গেছে। সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি বাঙালিরা যখন থেকে এসেছেন তখন থেকেই চালু হয়ে গেছে দেশ ও সমাজের যাবতীয় কর্মকা-। এখন এমন এক পরিবেশ আপনি যা চান যেভাবে চান তাই পাবেন।
দশ বছর আগেও আমরা ভাবতাম আমাদের প্রজন্মই শেষ প্রজন্ম, যাদের পর আর কেউ বাংলা গান বাজনা কবিতা নাটকের চর্চা করবে না। কিন্তু সে আশঙ্কার মুখে ছাই দিয়ে সমানে চলছে বাংলা বাঙালির জয়জয়কার। আজ দুটি আয়োজনের কথা বলব, যা দীর্ঘ সময় ধরে সিডনিকে সিডনির বাঙালি সমাজকে পুষ্ট করে চলেছে। প্রথমেই আসি বহুজাতিক মিডিয়া এসবিএস প্রসঙ্গে। এই এসবিএসের পুরো নাম হচ্ছে স্পেশাল ব্রডকাস্টিং সার্ভিস, যা সত্যিকার অর্থেই আমাদের জন্য বিশেষ বা স্পেশাল।
১৯৯৬ সালে এদেশে আসার পর ছোট কলেবরের দু’একটি বাংলা মুদ্রিত পত্রিকা ছাড়া আর কোনো মিডিয়া ছিল না। তখন ঘরে ঘরে মোবাইল ল্যাপটপ আই রিডার এসবের কোনো বালাই ছিল না। ফলে আমাদের সবকিছু সীমাবদ্ধ ছিল সেখানেই। প্রয়াত নূরুল আজাদ প্রয়াত পিএস চুন্নু আর চলমান লুৎফর রহমান শাওন এরা খেটে খুটে টাকা পয়সার জোগান দিয়ে স্বদেশ বার্তা নামে একটি পত্রিকা করতেন। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া এই পত্রিকাটির পর আমাদের সবার সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এসবিএস রেডিও। এক সময় অনেক বাংলা এফএম রেডিও চালু ছিল এই সিডনিতে।
সপ্তাহন্তের দুপুরে সেগুলো শোনার ও মানুষ ছিল প্রচুর। নাম উল্লেখ না করেই শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি তাদের রেডিওগুলো বাঙালির রাজনীতি সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে ভালো ভালো অনুষ্ঠান করলেও তার পরিধি ছিল সীমিত। বড় পরিধির মূল ধারার মিডিয়া এসবিএস টিভি আর রেডিওই আমাদের মূল ধারায় প্রোথিত করার কাজটি করে, যা এখনো চলছে। সেই ১৯৯৮ সালে এসবিএস টিভির সঙ্গে আলাপচারিতায় আমার কথা বলার শুরু।
পরে রথীন মুখার্জি, রেজা আরেফিন এদের হাত ঘুরে এখন এসবিএস রেডিও বাংলার দায়িত্বে আছেন সিকদার তাহের আহমদ। এবার এসবিএস বাংলার ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এই লম্বা সময়ে যখন থেকে তারা বাংলা রেডিও চালু করেছেন তখন থেকেই আমরা দেশ, পশ্চিম বাংলা ও প্রবাসের সব খবরাখবর নিয়মিত পাচ্ছি। পাচ্ছি মতামত।
এসবিএস বাংলা রেডিওর আন্তর্জাতিক প্রভাব আরও সুদৃঢ় হোক। সব মতভেদ আর সংকীর্ণতার ওপরে ওঠে আমাদের প্রবাসী জীবনকে আলোকময় করুক এই মূলধারার বাংলা মিডিয়া। ৫০তম জন্মদিনে বাংলা বাঙালির তরফ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
এবার আসছি ভবের হাট প্রসঙ্গে। দুই বোন ফারিয়া আর লামিয়াকে আমি চিনি অনেক আগে থেকে। অধুনা নিষ্ক্রিয় গানের দল সুধানিঝরে এসেছিল তারা। তাদের গানের গলা আর লোকজ গানের প্রতি ভালোবাসা এ নিয়ে কোনো সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই।
পরবর্তীতে নানা প্রতিকূলতার ভেতর ও তারা এগিয়ে গেছে। কতটা এগিয়েছে তার প্রমাণ পেলাম ভবের হাট সিজন ৯ দেখতে গিয়ে। এর আগে দু-একবার আমন্ত্রণ পাওয়ার পরও যেতে পারিনি। কিন্তু এবার ফারিয়ার আমন্ত্রণ না রাখার কোনো উপায়ই ছিল না। শীতের সন্ধ্যায় কাঁপতে কাঁপতে পৌঁছে গেলাম দুই প্রবীণ। আমি আর গামা আবদুল কাদির। সেখানে গিয়ে পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা মিলে গেল শফিক ভাইয়ের সঙ্গে। এক সময়ের তুখোড় ছাত্র নেতা। আড্ডা চা কফির পর মিলনায়তনে ঢুকে দেখি কানায় কানায় পূর্ণ।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন জনপ্রিয় উপস্থাপক শাকিল চৌধুরী। পূর্ণ অডিটোরিয়ামে যেন এক অন্যরকম আবহÑ প্রবাসে বসেও বাংলার গন্ধ, বাংলার মাটি ও মানুষের গান ছুঁয়ে দিল সকলের মন।
‘ভবের হাট সিজন ৯’-এর সূচনা হয় ময়মনসিংহ গীতিকার ‘সখীগো আমার মন ভালো না’ থিম গান দিয়ে। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও পরিচালনায় ছিলেন ফারিয়া আহমেদ। শাকিল চৌধুরীর প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় এবং অর্পিতা সোম চৌধুরীর কোরিওগ্রাফিতে মঞ্চে জীবন্ত হয়ে ওঠে স্বদেশ। রাজন নন্দীর ক্যারিশমা, অর্পিতা সোম চৌধুরীর দলীয় পরিবেশনা এবং ঐতিহ্যবাহী বাউল গানের ছন্দে সৃষ্টি হয় এক মায়াবী পরিবেশ।
গান পরিবেশন করেন বনফুল বড়ুয়া, লামিয়া আহমেদ, নিলাদ্রী চক্রবর্তী এবং ভবের হাটের কর্ণধার ফারিয়া আহমেদ। নৃত্য পরিবেশন করেন অর্পিতা সোম চৌধুরী ও তাঁর দল।
ফারিয়া ও লামিয়ার কথা আলাদা করে বলার আগে বলি নিলাদ্রী আর সোহেল খানের কথা। নিলাদ্রী গেয়ে যেমন মন ভরিয়ে দিয়েছিল তেমনি দিলরুবা খানের সুযোগ্য পুত্র সোহেল মন ভরিয়েছেন যন্ত্র মূর্ছনায়। এছাড়াও ছিলেন ফায়সাল সজীব, বিজয় সাহা, বনফুল বড়ুয়া আর শ্রদ্ধাভাজন অগ্রজ লোকমান হাকিম।
তবে মূল অনুষ্ঠানটি ধরে রাখার কৃতিত্ব দুই সহোদরার। লামিয়ার কণ্ঠটি যেমন ধারালো তেমনি সুরময়। তার কণ্ঠে বাংলা বাঙালির চিরচেনা বাউল আর লোকজ গানগুলো শ্রুতিমধুর হয়ে উঠেছিল। আর ফারিয়া ছিল আসরের মধ্যমণি। তার সুরেলা আওয়াজ আর মঞ্চের ওপর দখল আমাকে মুগ্ধ করেছে। ফারিয়া যখন দরকার তখন কোনো কিছু থামিয়ে দিতেও বিলম্ব করেনি। মূল কথায় তার কারণেই অনুষ্ঠানটি ছিল সুচারু।
এই আয়োজনে ভবের হাট সিডনির প্রিয় দুই মানুষ নাজমুল ভাই আর সালিকিন ভাইকে নিয়ে গুণীজনদের সম্মাননা জানিয়ে আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করেছে। এর মূল্যায়ন হবে সময়ের আলোকে।
মূল কথা এই প্রবাস জীবনে আমরা আর একা থাকি না। থাকি সুর সংগীত কবিতা নাটক চলচ্চিত্র আড্ডা মিলিয়ে রসে বশে। জয় হোক বাঙালির।
[email protected]
প্যানেল হু