
শারীরিক শিক্ষা মানে শুধু খেলা বা ব্যায়াম নয়, এটি এক ধরনের জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা
শারীরিক শিক্ষা মানে শুধু খেলা বা ব্যায়াম নয়, এটি এক ধরনের জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা, যা একজন মানুষকে সুস্থ, সচেতন, আত্মনির্ভরশীল এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। সুস্থ জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম। দীর্ঘস্থায়ী সুখী জীবনের মূল চাবিকাঠি শারীরিক শিক্ষা আর খেলাধুলা। শারীরিক শিক্ষা সাধারণ শিক্ষার একটি অংশ। শারীরিক শিক্ষা ছাড়া শিক্ষার পূর্ণতা আসে না। কোন একটা অঙ্গহীন মানুষ যেমন পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয়, ঠিক তেমনি শারীরিক শিক্ষা ছাড়াও আমাদের সাধারণ শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা হতে পারে না।
শারীরিক শিক্ষা শুধু শারীরিক বিকাশই ঘটায় না এটি মানসিক, আত্মিক ও চারিত্রিক বিকাশ ঘটিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে আগামীদিনের দায়িত্ববান পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে। একটি সুস্থ সুন্দর এবং সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শারীরিক শিক্ষার পেছনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ ও শারীরিক শিক্ষার ব্যাপক চাহিদা, প্রসার এবং গবেষণা থাকলেও আমদের দেশের চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে শারীরিক শিক্ষা চরমভাবে অবহেলিত। চীনে কোনো শিশু সাঁতার না জানলে তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় না। জার্মানরা বলেন, আমরা হাসপাতাল চাই না, আমরা খেলার মাঠ চাই, আমরা ব্যায়ামাগার চাই। শারীরিক শিক্ষার অজ্ঞতা আর অন্ধত্ব নিয়ে এ যুগে প্রাণী মানুষ বাঁচলেও সুস্থ মানুষ হিসেবে বাঁচা চলে না।
দেশের বিভিন্ন কলেজে কর্মরত শরীরচর্চা শিক্ষকরা বহুদিন ধরে একটি বৈষম্যমূলক ও অবহেলিত বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছে, যা তাদের পেশাগত সম্মান, প্রেষণা ও মানবিক মর্যাদাকে বারবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। শিক্ষা শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একজন শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য শারীরিক, মানসিক, নৈতিক এবং আত্মিক শিক্ষার সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। অথচ এই শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করা সত্ত্বেও কলেজ পর্যায়ে এ শিক্ষা আজও ন্যায্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। এটি শুধু আমাদের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও একটি দুঃখজনক ব্যত্যয়।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি আজও অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ এ বয়সে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে শারীরিক সুস্থতা, খেলাধুলা, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং নৈতিক অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা কেবলমাত্র সুশৃঙ্খল ও কাঠামোবদ্ধ শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব।
শারীরিক শিক্ষাও মানবগতি কার্যের বিজ্ঞান ও কলা। শারীরিক সুস্থতা, পারস্পারিক মেলামেশা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে খেলাধুলা। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষার কোনো প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই, নেই প্রয়োজনীয় ক্রীড়াসামগ্রী কিংবা খেলার উপযুক্ত পরিবেশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই পাঠটি গুরুত্বহীন হিসেবে বিবেচিত হয়, ফলে শিক্ষার্থীরা তা গ্রহণে আগ্রহী হয় না। এই অবহেলার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শারীরিক সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, মানসিক চাপ বাড়ছে, আর নেতৃত্ব, সহনশীলতা ও দলগত চেতনার মতো মানবিক গুণাবলি গড়ে উঠছে না। একটি সুস্থ সমাজ গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জাপান, আমেরিকাসহ প্রায় সব দেশে কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষার বিষয়টি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর স্পোর্টস অ্যান্ড ফিজিক্যাল এডুকেশন এবং আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের ২০১২ সালের ‘শেপ অব দ্য নেশন রিপোর্টে’ দেখা গেছে প্রায় ৭৫% রাজ্যে উচ্চ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়, অর্ধেকেরও বেশি রাজ্য শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শারীরিক শিক্ষা ক্রেডিটের জন্য অন্যান্য ক্রিয়াকলাকে প্রতিস্থাপন করার অনুমতি দেয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু ছয়টি রাজ্যে (ইলিনয়, হাওয়াই, ম্যাসাচুসেটস, মিসিসিপি, নিউইয়র্ক এবং ভারমন্ট) প্রতিটি গ্রেড স্তরে শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে।
ঐতিহাসিকভাবে, শারীরিক শিক্ষার ক্ষেত্রটি তিনটি শেখার ক্ষেত্রের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে: আবেগপূর্ণ, জ্ঞানীয় এবং মনো-মোটর। তবে শারীরিক শিক্ষার বৃত্তি সম্প্রতি শেখার দুটি অতিরিক্ত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে সম্প্রতি, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন এবং যুক্তরাজ্যের গবেষকরা শারীরিক শিক্ষার পাঁচটি শেখার সংস্থা হিসাবে বোঝার জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রগুলোকে পুনর্গঠন করেছেন: চলমান শরীর, চিন্তাভাবনা শরীর, আবেগগত শরীর, সামাজিক শরীর এবং সাংস্কৃতিক শরীর।
শারীরিক শিক্ষা এবং শিক্ষার একাডেমিক সাহিত্যকে আরও বিস্তৃতভাবে ব্যবহার করে এই পুনর্গঠন করা হয়েছিল। যে কোনো কাঠামোগত অথবা পুনরাবৃত্তিমূলক শারীরিক কার্যকলাপ সম্পাদিত বা অনুশীলন করা হয় যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য হল উন্নত শারীরিক সুস্থতা অর্জন করা। খেলাধুলা ভিত্তিক পদ্ধতির সম্ভাব্যতা ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারে উন্নয়নের ফলাফল আন্তর্জাতিক নীতি জুড়ে স্বীকৃত হয়েছে ঘোষণা, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে টেকসই জন্য ২০৩০ এজেন্ডা উন্নয়ন।
করতে টেকসই উন্নয়নে খেলাধুলা ভিত্তিক নীতির অবদান, শারীরিক কার্যকলাপ এবং শারীর শিক্ষানীতি এসডিজিতে মুখ্য খেলাধুলার টেকসই উন্নয়ন, শারীরিক শিক্ষা এবং শারীরিক কার্যকলাপ নীতি এবং গঠনমূলক ও সমষ্টিগত উভয় নীতির জন্য দক্ষ পরিকল্পনা ও নকশা প্রয়োজন। শারীরিক শিক্ষা, শারীরিক কার্যকলাপ এবং খেলাধুলায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে।
এই পাঠটিকে গুরুত্বহীন মনে করে অনেকেই অবহেলা করেন, ফলে শিক্ষার্থীরাও আগ্রহ হারায়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শারীরিক সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, মানসিক চাপ বাড়ছে এবং নেতৃত্ব, সহনশীলতা ও দলগত চেতনার মতো মূল্যবান গুণাবলি গড়ে উঠছে না। চরম অবহেলার ফলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষার জন্য নেই প্রয়োজনীয় উপকরণ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক কিংবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ কমে যাচ্ছে, স্বাস্থ্যগত সমস্যা বাড়ছে এবং নেতৃত্বের গুণাবলি ও আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিচ্ছে।
এ অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি, শিক্ষানীতিতে শারীরিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এবং যথাযথ বাজেট বরাদ্দ। পাশাপাশি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে শারীরিক শিক্ষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শারীরিক শিক্ষার মানেই কেবল খেলা নয়, এটি একটি জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা যা ভবিষ্যতের জন্য একজন মানুষকে সবদিক দিয়ে প্রস্তুত করে তোলে। আজকে শিক্ষার্থী আগামীদিনের নাগরিক। আর সেই নাগরিককে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষার বিকল্প নেই। আর শারীরিক শিক্ষা মানুষকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও জাতীয়ভাবে স্বাবলম্বী করে।
শারীরিক শিক্ষাকে অবহেলার হাত থেকে বাঁচাতে পারলে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে। এখন সময় এসেছে শারীরিক শিক্ষাকে তার প্রাপ্য সম্মান ও গুরুত্ব দেওয়ার। শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকলে ইউরোপের অনেক দেশেই বিদেশী শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ পাওয়া সহজ হয়।
সুস্থ জাতি গঠনের জন্য শারীরিক শিক্ষাকে শিক্ষার মূলধারায় সম্পৃক্ত করা সময়ের দাবি। এটি শুধু ব্যক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং জাতীয় উন্নয়নেরও অন্যতম পূর্বশর্ত। তাই আজই সময় শারীরিক শিক্ষাকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়ার যাতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হয় আরও সুস্থ, সবল ও উন্নত। শারীরিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা। স্কুল-কলেজে এই শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও মানসম্মতভাবে চালু করতে হবে। শুধু সরকার নয়, পরিবার ও সমাজকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শারীরিক শিক্ষাকে তার যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুস্থ নাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষার সর্বস্তরে শারীরিক শিক্ষা খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিষয়কে বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। একটি সুস্থ, কর্মক্ষম ও নৈতিকভাবে উন্নত জাতি গঠনের জন্য শারীরিক শিক্ষাকে অবহেলা নয়, বরং অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। শিক্ষার পূর্ণতায় এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থে শারীরিক শিক্ষাকে মূল পাঠ্যক্রম ও বোর্ড সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করে পাবলিক পরীক্ষায়ও অন্তর্ভুক্তির কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষক
প্যানেল হু