
ভার্চুয়াল জগতে পোর্টফোলিও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রোফাইল
ভার্চুয়াল জগতে পোর্টফোলিও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রোফাইল। এটি হচ্ছে ব্যক্তির নিজের কর্মক্ষমতা, দক্ষতা, জ্ঞান, গুণাবলি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের সুন্দরতম উপস্থাপন, যার মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতিভা, আগ্রহ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সহজভাবে বলা যায় পোর্টফোলিও হলো একজন ব্যক্তির কর্মজীবন এর বিভিন্ন ঘটনাবলির সংকলন। বর্তমানে পোর্টফলিও জীবনবৃত্তান্তর সহকারী হিসেবেও কাজ করে।
বিশেষত আইসিটি এবং মিডিয়া সেক্টরে একাডেমিক সার্টিফিকেটের চেয়ে পোর্টফোলিওই বেশি মূল্যায়িত হয়। যেমন- কেউ যদি মডেলিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাকে অবশ্যই তার পোর্টফলিওতে তার সুন্দর সুন্দর পোজ দেওয়া ছবি দিতে হবে। আবার কেউ একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হতে চায় তার পোর্টফোলিওতে নিজের দক্ষতা উপস্থাপনের জন্য কাজগুলো তুলে ধরতে হবে। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে আগ্রহী ব্যক্তিরা ওই প্রার্থী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে। এটি কারও কাজের একটি ভিজ্যুয়াল প্রমাণপত্র, যা তার দক্ষতা এবং যোগ্যতাকে তুলে ধরে।
পোর্টফোলিও বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন: ১. পেশাদারী পোর্টফোলিও: এটি সাধারণত ফ্রিল্যান্সার, ডিজাইনার, ডেভেলপার, লেখক, বা অন্য যে কোনো পেশাজীবীর জন্য তৈরি করা হয়, যারা তাদের কাজ অন্যদের দেখাতে চান। এই পোর্টফোলিওতে সাধারণত কাজের নমুনা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং যোগাযোগের তথ্য দেওয়া থাকে। এখানে কর্মজীবনের অর্জন, প্রকল্প, এবং প্রফেশনাল কাজের নমুনা সঙ্গে। এটি চাকরি আবেদন বা গ্রাহকদের কাছে নিজের দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়। ২. বিনিয়োগ পোর্টফোলিও: এখানে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সম্পদ যেমন- স্টক, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, ইত্যাদি একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে রাখা হয়, যা বিনিয়োগকারীর ঝুঁকি এবং লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে বিনিয়োগের ঝুঁকি কমানো এবং লাভ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
অন্যান্য পোর্টফোলিও হলো : ১. ব্যক্তিগত পোর্টফোলিও: ব্যক্তিগত সৃষ্টিশীল কাজের উদাহরণ, যেমন ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, লেখালেখি, বা ডিজাইন কাজের সংগ্রহ। ২. শিক্ষাগত পোর্টফোলিও: শিক্ষার্থীর প্রকল্প, গবেষণা এবং শিক্ষাগত অর্জনের উদাহরণ। এটি শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে মূল্যায়নের জন্য জমা দেওয়া হয়। ৩. অনলাইন পোর্টফোলিও: ডিজিটাল ফরম্যাটে তৈরি, যা ওয়েবসাইট বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শিত হয়। তবে পেশা আর কাজের ক্ষেত্র অনুযায়ী পোর্টফোলিওর ধরন আলাদা হয়।
যেমন, একজন সেলস ম্যানেজার তার ক্লায়েন্টের সংখ্যা, সেলসের পরিমাণ ও সেলস কর্মী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত তথ্য একটি ডকুমেন্টে সংরক্ষণ করতে পারেন। আবার একজন গ্রাফিক ডিজাইনার তার কাছে থাকা নিজের ডিজাইনের নমুনা আর ডিজাইনে ব্যবহৃত সফটওয়্যার বা টুল ও ক্লায়েন্ট সম্পর্কিত তথ্য রাখেন। প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ফরম্যাটে পোর্টফোলিও বানানো সম্ভব। যেমন: ওয়ার্ড ডকুমেন্ট, এক্সেল শীট, পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট ও ব্লগ, কমিউনিটি ওয়েবসাইট, প্রোগ্রামার ও ডেভেলপারদের জন্য গিটহাব (GitHub), গ্রাফিক ডিজাইনার ও ইউএক্স ডিজাইনারদের জন্য বিহ্যান্স (ইবযধহপব), আর্টিস্টদের জন্য ডিভিয়েন্টআর্ট (DeviantArt) ইত্যাদি।
একটি পোর্টফোলিও প্রফেশনাল দক্ষতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার একটি বড় প্রমাণ। কমবেশি সব কাজের জন্য পোর্টফোলিও বানানো যায়। যেমন একজন বেকার নিজের তৈরি কেক ও পেস্ট্রির ছবি দিয়ে তার বেকিং দক্ষতা নিয়ে অন্যদের জানাতে পারেন। আরও আছে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, ওয়েব ডিজাইনার, অ্যানিমেটর, থ্রিডি আর্টিস্ট, থ্রিডি অ্যানিমেটর, আর্টিস্ট, মডেল ও অভিনেতা ইত্যাদি।
ভার্চুয়াল জগতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সঙ্গে, পোর্টফোলিও তৈরি এবং উপস্থাপনের জন্য ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রাফিক ডিজাইনাররা তাদের ভার্চুয়াল জগতে তৈরি করা কাজগুলো পোর্টফোলিওতে যুক্ত করতে পারে। এছাড়াও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ঠজ) এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি (অজ) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারেক্টিভ পোর্টফোলিও তৈরি করা যায়, যা ব্যবহারকারীদের আরও আকর্ষক অভিজ্ঞতা প্রদান করে। সুতরাং ভার্চুয়াল জগত পোর্টফোলিও তৈরি ও উপস্থাপনের জন্য একটি নতুন এবং কার্যকর মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বিনিয়োগকারীদের জন্য পোর্টফলিও একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম।
কারণ একজন বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগযোগ্য অর্থ যেসকল ক্ষেত্রে যেমন স্টক, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ও অন্যান্য সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করেন পোর্টফোলিওর মাধ্যমে। তাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একজন বিনিয়োগকারীর সফলতার জন্য সঠিক উপায়ে পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একজন বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগযোগ্য অর্থ যেসকল ক্ষেত্রে যেমন স্টক, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ও অন্যান্য সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করেন পোর্টফোলিওর মাধ্যমে। পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট হলো বিনিয়োগ থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করার জন্য বিনিয়োগের সঠিক মাধ্যমগুলো নির্বাচন করে সঠিক অনুপাতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ বরাদ্দকরণের একটি প্রক্রিয়া।
এটি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সামগ্রিক ঝুঁকি কমিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করতে সহায়তা করে। এর অন্যতম এবং উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে: মূলধন বৃদ্ধি করা, বিনিয়োগ থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা, ঝুঁকি হ্রাস করা, তারল্য নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্টকে সাধারণত দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়: ১. সক্রিয় পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা (অপঃরাব চড়ৎঃভড়ষরড় গধহধমবসবহঃ) বলতে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার এমন একটি কৌশলকে বোঝায় যেখানে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক নিয়মিতভাবে বাজারের পরিবর্তনগুলির ওপর ভিত্তি করে তাদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে থাকা সম্পদগুলোর পরিবর্তন ও সমন্বয় করে, যার লক্ষ্য হলো বাজারের চেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করা। সক্রিয় পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার মূল ধারণা হল, বাজারকে ‘হারিয়ে’ দেওয়া বা বাজারের গড় রিটার্নকে ছাড়িয়ে যাওয়া। এর জন্য বিনিয়োগ ব্যবস্থাপকরা সাধারণত নিম্নলিখিত কৌশলগুলো ব্যবহার করেন, যেমন: বাজার গবেষণা ও বিশ্লেষণ: সক্রিয় ব্যবস্থাপকরা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সম্পদ (যেমন স্টক, বন্ড, ইত্যাদি) এবং বাজারের প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করেন।
বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ: এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, তারা তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা সম্পদগুলোর ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেন, যা বাজারের গতিবিধি এবং তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: সক্রিয় ব্যবস্থাপকরা পোর্টফোলিওর ঝুঁকি (যেমন বাজারের অস্থিরতা) কমাতে চেষ্টা করেন। বিভিন্ন সম্পদ শ্রেণিতে বিনিয়োগ: তারা বিভিন্ন ধরনের সম্পদ শ্রেণিতে (যেমন ইকুইটি, রিয়েল এস্টেট ইত্যাদি) বিনিয়োগ করে তাদের পোর্টফোলিওকে বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা করেন।
২. প্যাসিভ পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট (Passive Portfolio Management) হলো একটি বিনিয়োগ কৌশল যা একটি নির্দিষ্ট বাজার সূচক বা বেঞ্চমার্কের কর্মক্ষমতা অনুকরণ করার চেষ্টা করে। এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সূচকের স্টক বা বন্ড কেনেন এবং সেগুলোকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ধরে রাখেন, যা বাজারের সামগ্রিক কর্মক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রিটার্ন পাওয়ার চেষ্টা করে। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি: প্যাসিভ ম্যানেজমেন্টের মূল লক্ষ্য হলো বাজারের সামগ্রিক কর্মক্ষমতাকে প্রতিফলিত করা, অর্থাৎ বাজারের উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে পোর্টফোলিওটিরও ওঠানামা করবে।
কম খরচ: এই পদ্ধতিতে সাধারণত কম লেনদেন এবং ব্যবস্থাপনা ফি জড়িত থাকে, কারণ এখানে বাজারের গতিবিধি অনুযায়ী ঘন ঘন কেনা-বেচা করার প্রয়োজন হয় না। স্বল্পঝুঁকি: একটি নির্দিষ্ট সূচক অনুসরণ করার কারণে পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য বজায় থাকে, যা ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ: প্যাসিভ কৌশল সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত, যেখানে বাজারের ওঠানামাকে উপেক্ষা করে একটি স্থিতিশীল রিটার্ন পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কম প্রচেষ্টা: এই পদ্ধতিতে সক্রিয় ব্যবস্থাপনার মতো বাজারের গতিবিধি বিশ্লেষণ করে ট্রেড করার প্রয়োজন হয় না, তাই এটি কম প্রচেষ্টা সাপেক্ষ।
পোর্টফোলিও শব্দটি বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হতে পারে, তবে এর মূল ধারণা হলো একটি নির্দিষ্ট সংগ্রহ বা তালিকা যা কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য পূরণের জন্য উপস্থাপন করা হয়। ভালোভাবে তৈরি করা একটি পোর্টফোলিও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে এবং ব্যক্তি বা দলকে তাদের কাজের প্রতি আরও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তবে কিছু ক্ষেত্রে, পোর্টফোলিও একটি নির্দিষ্ট সময়ের কাজের প্রতিনিধিত্ব করে এবং বর্তমান পরিস্থিতি বা ভবিষ্যতের কাজের সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা নাও দিতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল হু