ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ছাত্র রাজনীতি: গৌরব, সংকট ও করণীয়

ইয়াসির আরাফাত, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১৩:৩৭, ১৪ জুন ২০২৫

ছাত্র রাজনীতি: গৌরব, সংকট ও করণীয়

ছবি: জনকণ্ঠ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ছাত্র রাজনীতি ছাড়া অকল্পনীয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থান—সবখানেই ছাত্রসমাজ ছিল পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়। আদর্শিক রাজনীতি, আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বের কারিগর হিসেবে ছাত্র রাজনীতি ছিল জাতির অন্যতম শক্তি।

গৌরবের ধারা
১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের গর্জে উঠাই ছিল জাতির জাগরণের সূচনা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া সালাম, রফিক, বরকত, জব্বাররা ছিলেন শিক্ষার্থী। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সংগঠনের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৯০-এর স্বৈরাচার পতন এবং সর্বশেষ ২০২৪-এ স্বৈরাচার পতনের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র ঐক্যই ছিল মূল চালিকাশক্তি। তৎকালে ছাত্র রাজনীতি ছিল আদর্শনির্ভর, শিক্ষার্থী ও জাতির সমস্যাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলা, ত্যাগের আদর্শে বলীয়ান এবং নেতৃত্বের মানোন্নয়ন। মেধাবী, চিন্তাশীল, সাহসী ও বুদ্ধিমানরাই ছিলেন নেতৃত্বের আসনে—ফলে রাজনীতিতে থাকত সেবা ও আদর্শের অনুশীলন।

চিত্র পাল্টে গেছে
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্র রাজনীতির গৌরবগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দলীয় লেজুড়বৃত্তিকরণ ছাত্র রাজনীতির মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো অনেকটাই পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দলের ছায়া বাহিনী হিসেবে। হল দখল, ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, শিক্ষক লাঞ্ছনা এবং ভিন্নমতের উপর শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের মহড়া, পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্ন, সেশনজট সৃষ্টির পেছনে ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। আরও উদ্বেগজনক হলো—এখানে নেতৃত্ব তৈরি হয় না মেধা, আদর্শিক গুণাবলি ও চিন্তাশীলতার ভিত্তিতে; বরং পাল্লা দিয়ে পোস্টারিং, শক্তি ও জনবল প্রদর্শন এবং পদবাজি দিয়ে। তাই অধিকাংশ শিক্ষার্থী এসবে ভয় পায় এবং ভবিষ্যতের ঝুঁকি মনে করে রাজনীতিতে আসতে চায় না, তথা “আই হেইট পলিটিক্স” নীতিতে বিশ্বাস করে। যদিও বারংবার দলীয় লেজুড়বৃত্তিহীন ছাত্র রাজনীতির আশার বাণী ফুটেছিল, তবে সেটা সফল হয়নি।

ছাত্র রাজনীতির এহেন অধঃপতনের পেছনের কারণগুলো কী?
রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে ছাত্র সংগঠনকে শুধুমাত্র ক্ষমতা লাভ ও জিইয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা, শিক্ষাক্ষণে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি ও দলীয় প্রভাবিতকরণ, আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি—এহেন কর্মকাণ্ড রাজনীতিকে সামাজিকভাবে ‘নোংরা’ হিসেবে চিহ্নিত করে, শিক্ষার্থীদের রাজনীতি বিমুখতা তৈরি করে।

যদিও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় সংগঠন রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ হয়ে সমাজসেবামূলক, পরিবেশবান্ধব, শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিতর্ক সংগঠন, সোশ্যাল অ্যাকটিভিজম, উদ্যোক্তা ক্লাব, বইপড়া ও পরিবেশ আন্দোলন—এসব প্ল্যাটফর্মে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব তৈরি করছে গঠনমূলক পদ্ধতিতে। তবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা, নেতৃত্ব বিকাশে, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ে এবং জাতির ক্রান্তিলগ্নে সুঠামদেহীর ন্যায় বীরদর্পে এগিয়ে এসে বুক চিতিয়ে দেওয়া অতীতের সেই সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতিরও প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটি কার্যকর হবে আদর্শিক, গণতান্ত্রিক, সুষ্ঠু ও শিক্ষার্থীবান্ধব হলে। ভবিষ্যতে ছাত্র রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন চাইলে এখনই কিছু সাহসী ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

করণীয়:
এক.
ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি থেকে বিরত থেকে আদর্শের রাজনীতি করতে হবে। যে আদর্শে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি রয়েছে, সেটা গ্রহণ করতে হবে। জাতির কল্যাণে জনগণের সেবায় নিজেকে বলীয়ান করতে হবে।

দুই. দলীয় লেজুড়বৃত্তিকরণ সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র সংগঠনের উপর প্রভাব বিস্তার না করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেবে। রাজনৈতিক দলের বলয়ে থাকলে ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারায়। রাজনীতি হবে শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশের স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম।

তিন. শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা। ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্ন হবে না। ক্যাম্পাসে অস্ত্রধারণ, ভিন্নমতের উপর হামলা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সহনশীল হতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও একাডেমিক সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ছাত্র রাজনীতি আদর্শচর্চার জায়গা হয়ে ওঠে।

চার. মেধাবী, চিন্তাশীল, সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন, ক্রিয়েটিভ ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের দলের নেতৃত্বে আনতে হবে। অছাত্র, বয়স্ক, বিবাহিত এবং নৈতিক গুণাবলীহীন কাউকে ছাত্র সংগঠনে রাখা যাবে না।

পাঁচ. নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে হবে যাতে গণতান্ত্রিক চর্চা পুনরুজ্জীবিত হয়। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের, যোগ্য, সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন, মেধাবী ও শিক্ষার্থীবান্ধব প্রার্থীকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করবে। এতে যোগ্যরা নেতৃত্বের আসনে আসবে এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্বাচিত ছাত্রনেতার দায়বদ্ধতা তৈরি হবে। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ে ছাত্রনেতারা সম্মুখ সারথি হয়ে থাকবে।

ছয়. সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ছাত্র সংগঠন ও ছাত্রনেতাদের। মাদক, দুর্নীতি, অবিচার, শোষণ, সামাজিক ব্যাধি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বজ্রকঠোর হতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সর্বাত্মক সচেষ্ট থাকতে হবে।

একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের উপর। শিক্ষার্থীদের সুসংগঠিত, আদর্শিক ও নেতৃত্ববান করে তুলতে হলে ছাত্র রাজনীতি হতে হবে ইতিবাচক, গণতান্ত্রিক, সমাজ ও শিক্ষার্থীবান্ধব। গৌরবের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সংকট নিরসন করে একটি শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্র রাজনীতির ভিত্তি এখনই গড়ে তুলতে হবে।

মুমু ২

×