ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২

‘মা’ প্রতিটি গল্পের নায়িকা

জান্নাতুল ফেরদৌস তানজিনা

প্রকাশিত: ১৬:৪৫, ১৪ মে ২০২৫

‘মা’ প্রতিটি গল্পের নায়িকা

মা- এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে বিশাল এক ভালোবাসা, আত্মত্যাগ আর নিঃস্বার্থ স্নেহের মহাসমুদ্র। নারী জাতির জীবনের পূর্ণতা পায় এই শব্দ দ্বারা। মাতৃত্ব কত সহজ আর সাধারণ একটি শব্দ অথচ এর সাথে জড়িয়ে আছে কত-শত ত্যাগ, স্মৃতি, আবেগ, অনুভূতি, দায়িত্ব, স্নেহ, মায়া, মমতা আর ভালোবাসা। মা হচ্ছেন সেই মানুষ, যিনি আমাদের পৃথিবীতে আনার পর নিঃস্বার্থভাবে লালন-পালন করেন, আমাদের হাসিতে হাসেন আর কান্নায় কাঁদেন। একজন নারীর জন্য কত কঠিন আর রোমাঞ্চকর হয় মা হওয়ার এই যাত্রা। কথায় আছে নারী ছেঁড়া ধন। এত কষ্ট জেনেও আমাদের মায়েরা অবলীলায় সব বরণ করে নেয় শুধু আমাদের জন্য। মা হওয়া মানেই শুধু জন্ম দেওয়া নয় - মা হওয়া মানে প্রতিদিন নিজেকে বিসর্জন দিয়ে বাচ্চাদের ভালোবাসা শেখানো। বাহিরের জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে ঘরের এককোণে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা। মা হওয়া মানে গভীর ঘুম চোখে নিয়েও রাত জেগে থাকা, দিনের পর দিন নির্ঘুম রাত হাসিমুখে পার করে দেওয়া। ক্লান্ত শরীরেও এক বুক ভালোবাসা উজাড় করে সন্তানের সেবা যত্ন করা। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসা। ছোট্ট মানুষটাকে গড়ে তুলতে গিয়ে প্রতিদিন নিজেকে হাজারবার ভাঙা-গড়া। ক্লান্ত চোখে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির ছায়া খোঁজা।
একজন নারী মা হওয়ার পর তাঁর জীবনে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে। যদিও মা হওয়া একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন তবে এর বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক কঠিন। একজন মেয়ে যখন প্রথমবারের মতো মা হয় তখন তার শরীর-মনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন হয়ে থাকে। নিজের চাহিদা, স্বপ্ন, আরাম-সব কিছু তিনি পাশে সরিয়ে রেখে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁচেন। সন্তান গর্ভে আসার পরেই একজন মায়ের জীবন যাপনে, চাল চলনে বিশাল পরিবর্তন চলে আসে, যার মধ্যে কিছু বিষয় মানিয়ে নিতে, খাপ খাইয়ে নিতে গিয়েও অনেক সময় মেয়েরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। একটা সময় সে নিজের জন্য সাজত, আয়নায় নিজেকে দেখতো, হাসত, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিত, নিজের ছোট ছোট ইচ্ছাগুলো নিয়ে বাঁচত। কিন্তু সন্তান জন্মদানের সময় সে হয়ে যায় ঘরকুনো, নিজেকে ভুলে যায়, খাওয়া, ঘুম, নিজের যত্ন সব ভুলে যায় আবার অনেক সময় ভিতরে ভিতরে ভেঙেও পড়ে, সে নিজেই আবার নিজেকে শক্ত করে তোলে। সন্তানের মুখের এক চিলতে হাসি, একটুখানি স্পর্শেই বেঁচে থাকে মায়ের সব স্বপ্ন। সন্তান জন্মদানের মাধ্যমেই একজন মা হয়ে উঠে কঠিন ব্যক্তিত্ব, অসীম সাহসী, দৃঢ়চেতা, মায়াবী এক যোদ্ধা যে নিজের সন্তানের বিপদে সব সময় ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।
মা মানেই ত্যাগের প্রতীক। মায়ের দৈনন্দিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্যাগের বিনিময়েই গড়ে উঠে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। একটা নতুন মা মানে শুধু মা হওয়া না, নিজেকে একটু একটু করে হারিয়ে ফেলা। যেখানে হারিয়ে ফেলা সৌন্দর্য নিয়ে কোনো আফসোস থাকে না, নির্ঘুম রাত পার করা নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকে না, সময়মতো খাবার খাওয়ার কোনো পরোয়া থাকে না, সন্তানের মুখের হাসির কাছে এইসব কিছুই যেনো তুচ্ছ। প্রথমবার মা হওয়ার আনন্দ যেমন অসীম, তেমনই এটি ভয় ও অনিশ্চয়তায় ভরা। একটি ছোট্ট প্রাণের জন্ম এক মুহূর্তে বদলে দেয় মায়ের পুরো পৃথিবী। রাতজাগা, নবজাতকের কান্না, স্তন্যপান করানো, নিজের শরীরের ক্লান্তি, সবকিছু মিলিয়ে একজন নতুন মা এক অবর্ণনীয় যাত্রার মধ্য দিয়ে যান। প্রসবের পর একজন মা শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই দুর্বল হয়ে পড়েন। তখন তার প্রয়োজন বিশ্রাম, ভালোবাসা ও মানসিক সমর্থন। কিন্তু সেটাও সবাই পায় না। তাও মায়েরা নিজের কথা ভুলে গিয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে সব কিছু মানিয়ে নেয়। কোনো কিছুর পরোয়া না করে নতুন জীবনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। একজন মা তার সন্তানের জন্য নিজের ক্যারিয়ার, নিজের স্বপ্ন সব কিছু বিসর্জন দিয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ সাজিয়ে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়, যেখানে থাকে না কোনো স্বার্থ। যুগের পর যুগ এভাবেই মায়েরা সন্তানদের জন্য নিজেদের উজাড় করে দিয়ে আসছেন। সন্তানকে আগলে রাখা, নিজের কষ্ট ভুলে সন্তানের সুখ নিশ্চিত করা এসকল আত্মত্যাগের মূল্য কোনো কিছু দিয়েই পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এজন্যই বলে মায়ের দুধের ঋন শোধ করা যায় না। মায়ের আদর, স্নেহ, পরামর্শ আর ছায়ার মতো আশ্রয় একজন সন্তানের জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট- বলেছিলেন “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি দিবো”। তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে একজন শিক্ষিত মা পুরো একটা জাতির ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সন্তানের সফলতা- ব্যর্থতার বেশির ভাগই নির্ভর করে মায়ের শিক্ষার উপর। একজন মা সন্তানের জীবনের প্রথম শিক্ষক। তার শিক্ষা, ভালোবাসা ও দৃষ্টিভঙ্গিই সন্তানকে মানুষ করে তোলে। মায়ের জ্ঞান, ধৈর্য এবং আন্তরিকতাই পারে সন্তানকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে। আবার সেই ঘাটতির জন্যই ব্যর্থতা আসতে পারে। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে একটি নতুন প্রাণ শৈশব, কৈশোর, যৌবন পার করে পূর্ণ রূপে একজন মানুষ হয়ে গড়ে উঠে। আর জন্মদাতা মা-বাবা হয়ে যায় বৃদ্ধ, তখন তাদের দায়িত্ব নিতে হয় সেই সকল সন্তানদের। তখনই সন্তান হিসেবে তাদের প্রকৃত সফলতা বা ব্যর্থতা অনুধাবন করা যায়। সন্তানের সাফল্য ও ব্যর্থতায় মায়ের অবদান অত্যন্ত গভীর এবং বহুমাত্রিক। একজন মায়ের ভূমিকা শুধু সন্তানকে জন্ম দেওয়ায় সীমাবদ্ধ নয় বরং তার চরিত্র গঠন, মূল্যবোধ তৈরি এবং ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণে মায়ের প্রভাব অপরিসীম। সন্তান সফল হলে সবচেয়ে আনন্দিত হন মা, আর ব্যর্থ হলে তিনিই হন সবচেয়ে বেশি ব্যথিত। একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর, কিন্তু সবচেয়ে কঠিন অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মা হওয়া, শুধু জীবন ঝুঁকি নিয়ে সন্তান জন্ম দেওয়াতেই যা সমাপ্ত নয় বরং কখনো ভালোবাসা দিয়ে, কখনো কঠোর হয়ে সন্তান কে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাও মায়ের বড় দায়িত্ব।
ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক- মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। কারন মা শুধু জন্মদাত্রী নন, বরং একজন পথপ্রদর্শক, অভিভাবক ও দোয়ার উৎস। মা শব্দটি শুধু একজন মানুষকে বোঝায় না, বোঝায় এক বিশাল অনুভূতিকে। মা মানে- নতুন জীবনের সূচনা, নতুন দায়িত্বের বোঝা। মা হওয়া মানেই শুধু সন্তান জন্ম দেওয়া নয়, এটি তার নিজস্ব সত্তারও একটি নতুন জন্ম। একজন মা সন্তান গর্ভধারণের মাধ্যমে নতুন করে নিজেকে উদ্ভাবন করে একজন শক্তিশালী, ধৈর্যবতী, অসীম সাহসী এক অস্তিত্ব কে যা তার নিজের কছেই অজানা ছিলো। একটি সুস্থ সুন্দর পরিবার গড়তে মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। একটি পরিবারকে মা-ই প্রথম একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়, একটা নতুন প্রজন্মের সূচনা করে। একজন সুখী মা মানেই একটি সুখী পরিবার। আর কতগুলো সুখী পরিবারই একত্রে গড়ে তোলে একটি সুন্দর সমাজ। বস্তুত সন্তান জন্মদানের মাধ্যমেই প্রকৃতভাবে একটি দম্পতি বাবা-মায়ের ত্যাগ সম্পর্কে ধারণা পেয়ে থাকে। একজন মা তার নিজের শরীর বিচ্ছিন্ন করে অসীম যে যন্ত্রণায় ভুগে তার সন্তান কে জন্ম দেয়, সেই যন্ত্রণার ব্যথাও নিমিষেই ভুলে যায় যখন সে দুই হাতে তার সন্তান কে বুকে জড়িয়ে ধরে। একজন মায়ের ভালোবাসা, কষ্ট আর আত্মত্যাগ সবকিছুই নিঃশব্দে ঘটে যায় কোনো অভিযোগ ছাড়া, আর এভাবেই মায়েরা একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলে। মা শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি অনুভূতি, একটি শক্তি, একজন পথপ্রদর্শক। মা আছেন বলেই আমরা পৃথিবীটাকে নিরাপদ মনে করি। তাই শত কষ্ট, ত্যাগ জেনেও মা হওয়া সবার স্বপ্ন। কারন এতেই রয়েছে একজন নারীর প্রকৃত সার্থকতা। আলহামদুলিল্লাহ, আমিও এখন একজন মা। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মায়েরা।

লেখক : শিক্ষার্থী,  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×