ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন

মোহাম্মদ ইমতিয়াজ উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন

গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় রাজধানী ঢাকার অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। প্রতিবছর গরমের তীব্রতা বাড়ছে। আর এর মূল শিকার হচ্ছেন ঢাকার সাধারণ মানুষ। অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ ঢাকাবাসী। ঘন ঘন লোডশেডিং ঢাকাবাসীর যন্ত্রণাকে আরও তীব্র করে তুলছে। প্রচণ্ড গরমে শিশুরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পোহাচ্ছে। একই সঙ্গে নগরীতে দেখা দিচ্ছে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে দায়ী এর জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট ও গাছপালা কেটে ফেলা। শহরের সবুজ মাঠ, খোলা জায়গা ও পুকুর খাল ধ্বংসের কারণে প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে গরমের অনুভূতি কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি অনুভূত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি স্থানীয় অনেক কারণও আছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে তাপমাত্রা ভিন্ন অনুভূত হয়। সবুজের অভাব এবং ঘরের ছাদে টিন ব্যবহারের কারণে দরিদ্রতম এলাকাগুলোয় বেশি গরম। এগুলো দিনের বেলা সূর্যের তাপ ধরে রাখে এবং রাতে খুব দ্রুত তাপ ছাড়ে না। এই অঞ্চলগুলো উঁচু ভবনবেষ্টিত হওয়ায় সহজে বাতাস প্রবাহিত হয় না। তাই গরম বাতাস আটকে থাকে। এছাড়া রাজধানীর জলাভূমিগুলো ধ্বংস হয়ে যাবার কারণে এখন শহরে ভবনের ভেতর শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তাপমাত্রা কমানো যাচ্ছে না। এসি ব্যবহারের ফলে তাপমাত্রা আরও বাড়ছে। তাছাড়া নগরে উন্মুক্ত স্থানগুলো আমরা নগরায়ণের নামে ভরাট করে ফেলেছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরে ৩০ ভাগ জলাশয় ও সবুজ এলাকা বাড়ানো উচিত। কিন্তু সেই জায়গায় আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না।
অতিরিক্ত গরমে ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক, রক্তচাপের সমস্যা দেখা দেয়। গরমের কারণে মানুষের কাজের স্পৃহা কমে যায়, বিরক্তি ও অবসাদ বাড়ে। গরমে এসি ও ফ্যানের ব্যবহার বেড়ে যায়, ফলে লোডশেডিংয়ের সমস্যা তীব্র হয়। অসহ্য গরমে জনজীবনের যখন হাঁসফাঁস, তখন ঢাকাবাসীর জন্য বাড়তি বিড়ম্বনা হিসেবে দেখা দিয়েছে বায়ুদূষণ। গরমে রাস্তায় ধুলাবালি ও যানবাহনের ধোঁয়া মিলে বায়ুদূষণ বেড়ে যায়, যা শ্বাসকষ্টের কারণ হয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রিজিলিয়ান্স সেন্টারের ‘হট সিটিজ, চিল্ড ইকোনমিক: ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিজ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় উচ্চ তাপমাত্রার কারণে প্রতি বছর ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রার ফলে ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকায় এরই মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিমাণ ৬০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে চলেছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, সাধারণত এপ্রিলে ঢাকার গড় তাপমাত্রা থাকে ৩৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বিগত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ১৯৬৫ সালে এপ্রিল মাসে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ১৯৬০ সালে ঢাকায় পারদ উঠেছিল রেকর্ড ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গাছ ও জলাশয় আছে এমন এলাকার চেয়ে ঢাকার তাপমাত্রা গড়ে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার। এসব যন্ত্রের ব্যবহার যতই বাড়ছে, ভবনের বাইরের এলাকার তাপমাত্রা ততই বাড়ছে। আবহাওয়া বিভাগের হিসাবে গত ১০০ বছরে দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় রাজধানীর তাপমাত্রা দেড় গুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকা শহরের এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ নিতে হবে তা হলো, শহরের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে গাছ লাগানো। সড়ক বিভাজকে শোভাবর্ধক গাছ ছাড়াও ভূমির ধরনের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম উপকারী বৃক্ষ যেমন ফলের গাছ, ঔষধি গাছ, কাষ্ঠল গাছও রোপণ করতে হবে। ছাদবাগান বাড়াতে হবে। দখলকৃত জলাভূমি উদ্ধার করতে হবে। সর্বোপরি এসব কারণ বিবেচনায় রেখে রাজধানী-সংক্রান্ত যাবতীয় জননীতি ঢেলে সাজাতে হবে। সরকারি পর্যায়ে বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ উদ্যোগ বাড়াতে হবে এবং বৃক্ষরোপণের প্রতি জনগণের উৎসাহ বাড়াতে বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আয়োজন করা প্রয়োজন।
সর্বোপরি, গরম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মানবসৃষ্ট কাজকর্মই বেশি দায়ী। তাই সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই অসহনীয় গরম থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সবুজায়ন, সচেতনতা ও পরিকল্পিত নগর উন্নয়নের মাধ্যমেই আমরা একটি শীতল ও স্বস্তিদায়ক ঢাকা গড়ে তুলতে পারি।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×