
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬২ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত। মানে কৃষি এখনো নিয়োগের বড় ক্ষেত্র। সম্প্রতি কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থনে রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বার্ষিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী, স্বাধীনতাপরবর্তী ৫৩ বছরে দেশের প্রধান প্রধান শস্য উৎপাদন তিন থেকে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ। এ পর্যন্ত লবণাক্ততা, খরা, প্লাবনসহিষ্ণু এবং জিঙ্কসমৃদ্ধ ১৩৪টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা দারিদ্র্য বিমোচনের একটি বড় অনুষঙ্গ, যা নিরসনে সরকার অবগত। খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে চাল গরিব মানুষের প্রধান অবলম্বন।
দেশে মোট চাল উৎপাদনের ৪০ শতাংশ হয় আমন মৌসুমে। চলতি মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। মোট ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে এ বছর ধানের আবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাটা হয়েছে ৫৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর বা সাড়ে ৯৭ শতাংশ জমির ধান। এখান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টন।
গড় ফলন হয়েছে হেক্টরপ্রতি ২ দশমিক ৯৮ টন। গত বছরের শেষদিকে পোকামাকড় এবং ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ও মিগজাউমের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধান। সে হিসেবে কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা রয়েছে। এ অনুযায়ী এবার আমনে উৎপাদন দাঁড়াতে যাচ্ছে রেকর্ড সর্বোচ্চে।
তবে রেকর্ড উৎপাদনের দাবি করা হলেও বাজারে এখন আকস্মিকভাবেই দাম বাড়ছে চালের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) মতে, জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট আয়ের ৪৭.৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। গরিব ও অতিগরিব পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। আবার তাদের চাল ভোগের পরিমাণও অন্যদের চেয়ে বেশি। যখন দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, তখন অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম।
প্রধান খাদ্যপণ্যটির মূল্যস্ফীতিতে তারা ভোগেন সবচেয়ে বেশি। বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লে ৭৩.৮ শতাংশ হতদরিদ্র পরিবার চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। দরিদ্র পরিবারের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। তাই চালের দাম উচ্চহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিগরিব ও গরিবদের খাদ্য নিরাপত্তা পড়ে চরম হুমকির মুখে। শুধু গরিব ও অতিগরিবরা নয়, চালের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের বাধ্য হয়ে আমিষ জাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শেষ দিনে (১০ ডিসেম্বর) আয়োজিত এক সেশনে ‘অ্যাগ্রিকালচারাল প্রোডাক্টিভিটি অ্যান্ড টেকনিক্যাল এফিশিয়েন্সি ইন বাংলাদেশ’ উপস্থাপিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দেশে জমির উর্বরতা দিন দিন কমছে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জমির উর্বরতা ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উর্বরতা শক্তি কিছুটা বেড়ে হয়েছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে কমে ঋণাত্মক (-০.৪৪ শতাংশ) হয়ে পড়ে। ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে উর্বরতা শক্তি আরও বেশি ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে, শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশে।
এদিকে জমির উর্বরতার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা। জমির উৎপাদন বৃদ্ধি নির্ভর করে দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবহারের ওপর। তবে সার, কীটনাশক ও ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহার পরিবেশকে অবনতির দিকে পরিচালিত করছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ ২০১২ সালে ছিল ১০ টাকা ৫১ পয়সা। সেটি বেড়ে ২০১৫ সালে হয়েছে ১১ টাকা ৬৭ পয়সা এবং ২০১৮ সালে ১২ টাকা ৮৮ পয়সা। পরবর্তী কয়েক বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, এক কেজি চাল বিক্রি করে লাভ হতো ২০১২ সালে ১৬ টাকা ১৭ পয়সা, ২০১৫ সালে ১৬ টাকা ৫২ পয়সা এবং ২০১৮ সালে ১৭ টাকা ৪৮ পয়সা। এ ক্ষেত্রে গড় লাভ আসে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। মোট উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রি করা অর্থের লাভজনকতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমছে। কৃষকরা তাদের বিনিয়োগে কম রিটার্ন পাচ্ছেন। কারণ, তাদের উৎপাদিত পণ্যের দামের তুলনায় খরচ দ্রুত বাড়ছে।
এ প্রবণতা ধান চাষিদের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। গবেষণায় দেশে কৃষি উৎপাদনশীলতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। জমির উর্বরা শক্তি বাড়াতে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করা, উর্বরতা পুনরুদ্ধার করতে নিয়মিত মাটি পরীক্ষা, জৈবসার প্রয়োগ এবং একই জমিতে ফসলের ঘূর্ণন (ভিন্ন ভিন্ন ফসল চাষ) করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চাষযোগ্য মাটির গুণাগুণ হ্রাস কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরেকটি বড় অন্তরায়। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার জমি অনুর্বর হয়ে পড়ছে। দেশের মোট জমির ৭৬.২ শতাংশ এখন মোটামুটি অনুর্বর। এর পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। ২০০০ সালে ১.০৭ কোটি হেক্টর জমি উর্বরতা হারিয়েছে বলে ধারণা করা হতো। বর্তমানে তা ১.১২৪ কোটি হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। এটা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে হুমকি। এর কারণ বহুবিধ। এর মধ্যে জমিতে অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ, চিংড়ি চাষের জন্য মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৃক্ষ নিধন ও বনভূমি উজাড় করা এবং জমিতে শিল্প ও ওষুধ বর্জ্য ফেলা অন্যতম।
জমির গুণমান হারানোর ফলে শস্যের পুষ্টিমান হ্রাস পায় এবং বন্যা ও খরায় ফসল উৎপাদনের উপযোগিতা হারায়। এক্ষেত্রে প্রতিকার হিসেবে জমিতে ফসল চক্রের পরিবর্তন, জৈবসার প্রয়োগ, শিল্প বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকা, বনভূমির গাছ কাটা থেকে নিবৃত হওয়া এবং ফসলি জমিতে চিংড়ি চাষকে নিরুৎসাহিত করা দরকার। তাছাড়া তামাক চাষ লাভজনক হলেও পরিবেশ ও মাটির গুণাগুণ সংরক্ষণের জন্য তা পরিহার করা উচিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ইইঝ) কৃষিশুমারি অনুযায়ী, বেশিরভাগ কৃষকের নিজস্ব জমি নেই। তারা অন্যের জমিতে কাজ করেন। সাম্প্রতিক কৃষি শুমারিতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশের বেশি কৃষক বা ভূমিহীন। গ্রামীণ কৃষক পরিবারের আয় তুলনামূলকভাবে কম। তারা প্রায়ই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। দারিদ্র্যের হার কৃষকদের মাঝে বেশি, বিশেষ করে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে। বেশিরভাগ কৃষক পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
মৌসুমের ওপর নির্ভরশীলতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা প্রায়ই খাদ্যের ঘাটতির সম্মুখীন হন। ভূগর্ভের পানির স্তর তলানিতে ঠেকেছে রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশাল এলাকাজুড়ে। পানির স্তর এতটাই নিচে নেমেছে যে, এখন বরেন্দ্রভূমির রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আট উপজেলার ২৬টি ইউনিয়ন এলাকায় ১৭০ ফুট খনন করেও পানি উঠছে না গভীর নলকূপে। এসব এলাকার হাজারো হস্তচালিত নলকূপ এক দশক আগেই অচল হয়েছে। অব্যাহত পানি সংকট মোকাবিলা ও ভূগর্ভের পানির স্তর রক্ষায় নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)।
কর্তৃপক্ষ বলছে, আসন্ন বোরো মৌসুমজুড়ে একটা গভীর নলকূপ ৯৮০ ঘণ্টার বেশি চালাবে না। বছরে একটা গভীর নলকূপ চলবে ১ হাজার ৯৬০ ঘণ্টা। কৃষকরা বলছেন, বিএমডিএর নতুন এ সিদ্ধান্তের কারণে বরেন্দ্রভূমির তিন জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর পানি সংকট এলাকাগুলোতে বোরো চাষ প্রায় অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। একটা গভীর নলকূপ এলাকার সেচ স্কিমের অর্ধেক জমিতে এবার বোরো চাষ করা যাবে। বাকি অর্ধেক জমিতে চাষ করতে হবে বোরো ছাড়া সেচ সুবিধাবিহীন প্রচলিত অন্য ফসল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নতুন করে দেশ পুনর্গঠনের বিভিন্ন দাবি উঠলেও, দুঃখজনকভাবে কৃষকদের অধিকারের প্রশ্ন অনেকাংশেই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষকদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা জাতির সামনে বাস্তবতা। তাই কৃষিক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও প্রয়োগ ধরন গবেষণার প্রয়োজন।
পাশাপাশি স্মার্ট ফার্মিং বাস্তবায়নে বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ আবির্ভূত হয়েছে, যেমন- ১. প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, ২. নলেজ গ্যাপ, ৩. ধীরগতির ইন্টারনেট, ৪. দেশীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের অভাব, ৫. কৃষক পর্যায়ে ট্যাব/ স্মার্টফোনের অভাব, ৬. আইনগত জটিলতা, ৭. মোটিভেশনের অভাব। কাজেই আমাদের উচিত হবে এখন থেকেই গুরুত্ব দিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী বিশাল জনবল গড়ে তোলার নিমিত্তে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেওয়া। অপরদিকে মাটির স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে মন দিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি)
সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা