ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

মুঘল থেকে বর্তমান ঢাকার ঐতিহ্যের এক অনন্য যাত্রা

হৃদয় পান্ডে

প্রকাশিত: ১৯:২৫, ১১ নভেম্বর ২০২৪

মুঘল থেকে বর্তমান ঢাকার ঐতিহ্যের এক অনন্য যাত্রা

ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী, এক ঐতিহাসিক শহর যার জাঁকজমকপূর্ণ অতীত এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ঝলক আজও স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে যখন এই শহরের বিকাশ ঘটেছিল, তখন থেকেই ঢাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। মুঘল আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঢাকার ইতিহাসের ধারাবাহিক পরিবর্তন এবং উন্নতির সাথে শহরের ঐতিহ্য বহমান রয়েছে। ঢাকার ঐতিহ্যের যাত্রা শুধু স্থাপত্যশৈলী সংস্কৃতির বিবর্তন নয়; বরং এটি একটি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতির প্রতিফলন।

মুঘল আমলে ঢাকার উত্থান

১৬০৮ সালে যখন ঢাকাকে মুঘল প্রশাসনের অধীনে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখন থেকেই এই শহরের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। মুঘলরা ঢাকাকে তাদের পূর্বাঞ্চলীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। মুঘল আমলে ঢাকার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর সমৃদ্ধ বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং কারুশিল্প, বিশেষত ঢাকাই মসলিনের উৎপাদন, যা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় ছিল। মসলিন কাপড়ের সূ²তা এবং সৌন্দর্যের কারণে ঢাকার নাম সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। "মসলিনের শহর" নামে খ্যাত এই ঢাকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বণিকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

মুঘল আমলে ঢাকায় যে ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর বিকাশ ঘটেছিল, তা আজও শহরের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। লালবাগ কেল্লা, হাজারীবাগ, এবং বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত বিভিন্ন মসজিদ মন্দিরগুলো আজও মুঘল স্থাপত্যের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। বিশেষ করে লালবাগ কেল্লা, যেটি মুঘল আমলের অন্যতম সুন্দর একটি স্থাপনা, তা আজও ঢাকার ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। শহরের ভেতরের এই কেল্লাটি মুঘল সাম্রাজ্যের শেষদিকে নবাব শায়েস্তা খানের অধীনে নির্মিত হয়েছিল এবং এখনও এটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান।

 

ব্রিটিশ শাসন ঢকার এক নতুন রূপান্তর

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা ঘটে, যা ঢাকার সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে অনেক পরিবর্তন আনে। ব্রিটিশ আমলে ঢাকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেকাংশে হ্রাস পায় এবং মসলিন শিল্প ধ্বংস হতে শুরু করে। ঢাকাই মসলিনের উৎপাদন এবং ব্যবসা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই সময়ে নতুন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা গড়ে ওঠে, যা ঢাকার আধুনিকতার দিকে অগ্রগতির সূচনা করে।

ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার অবকাঠামো এবং শহর পরিকল্পনার পরিবর্তন দেখা যায়। শহরে পশ্চিমা স্থাপত্যের প্রভাব পড়তে শুরু করে এবং ঢাকার রাস্তাঘাট, ভবন এবং অন্যান্য অবকাঠামোতে নতুনত্ব দেখা যায়। এই সময়ে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা দেশের শিক্ষা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বিশেষ মিকা পালন করে। তৎকালীন ঢাকা শহরে উদ্ভূত নবজাগরণ ঢাকার মানুষের রাজনৈতিক এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে সহায়ক হয়। ঢাকার ঐতিহ্যের উপর ব্রিটিশ স্থাপত্যের প্রভাব, যেমন - কার্জন হল, আহসান মঞ্জিল এবং অন্যান্য স্থাপত্য নিদর্শন, যা আজও শহরের বিভিন্ন অংশে দৃষ্টিগোচর হয়।

 

পাকিস্তান আমল ঢাকার পুনর্জন্মের সূচনা

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান নামে আত্মপ্রকাশ করে। এসময় ঢাকার আবার একটি নতুন পরিচিতি লাভ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই সময়ে, শহরে নতুন প্রশাসনিক ভবন এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। পাকিস্তান আমলে ঢাকা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে, যেখানে বাংলাভাষা এবং জাতীয় ঐতিহ্যের ওপর জোর দেওয়া হয়।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং জাতীয়তার প্রতি মানুষের আবেগ আত্মত্যাগ ঢাকাকে একটি ঐতিহাসিক শহর হিসেবে নতুনভাবে গড়ে তোলে। ভাষা আন্দোলনের পর ঢাকার সংস্কৃতিতে নতুনভাবে গণতান্ত্রিক চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। একে কেন্দ্র করেই স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত হয়।

 

মুক্তিযুদ্ধ এবং ঢাকার পুনর্জন্ম

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ঢাকায় শুরু হয় এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। ২৬ মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে পুরো বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং রাজপথে এই যুদ্ধের চিহ্ন বহন করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, তা ঐতিহাসিক সংগ্রাম এবং বীরত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১- ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

স্বাধীনতার পর ঢাকাকে বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এটি নতুন রূপে উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই শহরে এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান রয়েছে, যেমন - সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যেখান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল এবং শহীদ মিনার, যেখানে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকার এই স্মৃতিসৌধগুলো আজও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনার প্রতীক এবং প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে গভীরভাবে গাঁথা।

 

আধুনিক ঢাকা একটি কসমোপলিটন শহর

স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা এক নতুন গতি প্রকৃতিতে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে এই শহরকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। বর্তমান ঢাকা একটি কসমোপলিটন শহরের রূপ ধারণ করেছে, যেখানে দেশের প্রধান অর্থনৈতিক কার্যক্রম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে। তবে ঢাকার সা¤প্রতিক উন্নয়নের পথে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ এবং নগরায়ণের কারণে পরিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।

শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যানজট এবং দূষণের মতো সমস্যাগুলোর পাশাপাশি ঢাকার স্থাপত্যেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক আকাশচুম্বী ভবন, শপিং মল এবং বহুজাতিক হোটেলগুলো শহরের আকাশরেখাকে রূপান্তরিত করেছে। বর্তমানে শহরে রয়েছে বিশ্বমানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল। ঢাকা আজ দেশের উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত, যেখানে নতুন সুযোগ এবং সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই আধুনিকায়নের মধ্যেও ঢাকার ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

 

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য সংস্কৃতি

ঢাকার ঐতিহ্যের বড় একটি অংশ হলো এর প্রাচীন স্থাপত্য। লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, হোসেনী দালান, কার্জন হল, এবং বড় কাটরা ছোট কাটরা মুঘল ব্রিটিশ শাসনামলের স্থাপত্যের নিদর্শন। এই স্থাপনাগুলো আমাদের অতীত ঐতিহ্যের একটি ধারক এবং এটি আজও হাজারো পর্যটককে আকর্ষণ করে। ঢাকার স্থাপত্যশৈলী কেবল সৌন্দর্যের নিদর্শন নয়; বরং এটি ইতিহাসের এক চলমান ধারাবাহিকতা, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হলেও তার মূল চেতনাকে আজও ধরে রেখেছে।

অন্যদিকে ঢাকার ঐতিহ্যের অন্য বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। পুরান ঢাকার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী উৎসব এবং অনুষ্ঠান ঢাকার সংস্কৃতির প্রাণ। চৈত্রসংক্রান্তি, ঈদ, পূজা, এবং বিয়ের মতো অনুষ্ঠানগুলোতে পুরান ঢাকার মানুষের ঐতিহ্যবাহী আচার-আচরণ আজও রয়ে গেছে। এখানকার খাজা, কাবাব, বাখরখানি এবং পুরান ঢাকার রাস্তায় গন্ধে মাখামাখি নানান ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো বাংলাদেশের খাদ্যসংস্কৃতিতে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে আয়োজিত এই শোভাযাত্রায় সারা দেশ থেকে লাখো মানুষ অংশ নেন। এটি এখন ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত এবং বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্য এবং কৃষ্টির এক অনন্য উদাহরণ।

 

ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন

যদিও ঢাকা শহর তার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে গর্বের সাথে ধারণ করে, তবে আধুনিক যুগের নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি শহরের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দ্রæ নগরায়ণের ফলে ঢাকার পুরাতন ঐতিহ্যবাহী ভবন স্থাপনাগুলো হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ না করতে পারায় তা বিলুপ্তির পথে চলে গেছে বা আধুনিক ভবনের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশগত দিক থেকেও ঢাকা শহর আজ দূষণ, যানজট, এবং অন্যান্য সমস্যায় জর্জরিত। তবে আশার কথা হলো, সরকারের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি উদ্যোগ এবং সচেতন নাগরিকরা এই ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণে কাজ করছেন। বর্তমানে বেশ কিছু সংরক্ষণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যা ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোকে সংরক্ষণ এবং পুনর্র্নিমাণে সহায়ক হবে।

 

শেষ কথা

মুঘল আমল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত ঢাকার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। তবে যুগে যুগে পরিবর্তন হলেও ঢাকার মূল চেতনা আজও অটুট রয়েছে। লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিলের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা থেকে শুরু করে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা পর্যন্ত প্রতিটি প্রতীক ঢাকার ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত। ঢাকার এই দীর্ঘ ঐতিহ্য আমাদের সামনে একটি উদাহরণ স্থাপন করে, কীভাবে একটি শহর তার নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধারণ করে উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে। ঢাকা আজও একদিকে যেমন তার ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তেমনি আধুনিকতাকেও আপন করে নিয়েছে। ঢাকার এই ঐতিহ্যের অনন্য যাত্রা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস একে অপরের পরিপূরক এবং একসাথে থাকলেই একটি সমাজ সমৃদ্ধ সফল হতে পারে।

শিক্ষার্থী , ঢাকা কলেজ

×