প্রসঙ্গ ইসলাম
মুসলিম সমাজে সফর মাসের শেষ বুধবারকে ‘আখেরি চাহার শাম্বা’ নামে স্মরণ করা হয়। ‘আখেরি চাহার শাম্বা’ ফার্সি বাক্য। এর অর্থ শেষ বুধবার। এদিন আখেরি নবী হযরত রাসূলে আকরাম (স.) জীবনের অন্তিম রোগে কিছু উপশম লাভ করেছিলেন বলে মদীনাসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে পরম আনন্দের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। তা স্মরণে এনে প্রতিবছর মুসলমানরা এদিনটিকে আল্লাহর কাছে বিশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপনের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে।
প্রসঙ্গত বলা যায়, সফর মাসের এ বুধবারে হযরত রাসূলে কারীম (স.) একটু সুস্থতা অনুভব করলে জীবনের শেষ গোসল সেরে নেন। অবশেষে পরবর্তী মাস রবিউল আউয়ালে তিনি ইহজগত ত্যাগ করে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে পা বাড়ান। (ই. বিশ্ব কোষ ১/১১৩)।
কাজ শেষে রাজ দূত যেমন স্বদেশ ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে, মহানবীর অবস্থা ঠিক তেমন হয়েছিল। বিদায় হজ্জের পর তিনি কেন যেন বিমনা হয়ে পড়েন। মহাসিন্ধুর ওপাড় থেকে যেন কোনো বার্তা তিনি শুনতে পেলেন। তাঁর বয়স তখন তেষট্টি বছর। মীনা প্রান্তরে তিরিশ পারা কুরআনের শেষ আয়াত যেদিন নাযিল হলো, সেদিনিই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর মিশন ফুরিয়েছে, শীঘ্রই তাকে এখান থেকে ফিরতে হবে, হাজিরা দিতে হবে মহামহিম আল্লাহ তায়ালার দরবারে।
এ মহা প্রস্থানে মহা মুহূর্ত কখন ঘনিয়ে আসবে তাও তিনি জানতেন। এক স্নিগ্ধ রাত দুপুরে তিনি আপন খাদিম আবু মুহায়মা (রাদিঃ) কে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকিতে’ গমন করেন। যেখানে তিনি অতি বিনয়াদ্রভাবে জিয়ারত করেন আর বলেন : আস্সালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর। ওহে সমাধিশায়িতরা! তোমাদের ওপর সালাম বা আল্লাহর শান্তিধারা বর্ষিত হোক। আমরাও (আমিও) শীঘ্র তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব।’
তাঁর আকুল করা হৃদয়কাড়া মুনাজাতের ভেতর দিয়ে এমন এক মর্মস্পর্শী সুর বেজে উঠল যেন কোনো ব্যক্তি জীবনের শেষ মুহূর্তে তার আত্মীয়স্বজন হতে বিদায় গ্রহণ করে। পরবর্তীতে ক্রমেই তাঁর রোগ বৃদ্ধি পেতে লাগল। জ্বর এবং পেটের পীড়া দুটোই তীব্র হয়েছিল তাঁর। এ সময় বারে বারে তিনি বলতে লাগলেন : খায়বারে ইয়াহুদীনী যে বিষ খাইয়েছিল এর বিষক্রিয়া এখন আমি অনুভব করছি।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, খায়বার যুদ্ধে মুসলমান জয়লাভ করলে স্থানীয় ইয়াহুদীদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়। কিন্তু তবুও ইয়াহুদীদের কপটতা যায়নি। এক ইহুদী ছলনা করে হুজুর (স) কে খানার দাওয়াত করে। নবীজী সরল মনে তা কবুল করেন। খেতে গেলেন কয়েকজন সাহাবী নিয়ে। খাদ্যে ছিল বিষ মিশানো। হুজুর (স.) প্রথম এক টুকরো গোস্ত মুখে নিতেই চিৎকার করে বলে উঠলেন : সাবধান! এসব খেয়োনা। এতে বিষ মিশানো রয়েছে। অবশ্য সেদিন বিষাক্ত গোস্ত খেয়ে হুজুর (স.) এর মৃত্যু হয়নি ঠিকই, জীবন সয়াহ্নে সেই বিষক্রিয়া কিন্তু প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল।
হযরতের এই অসুস্থতার দিনে মেয়ে ফাতিমা (রাদিঃ) ছুটে এলেন তাকে দেখতে। তিনি গোপনে মেয়েকে কি যেন বললেন। অমনি মেয়ে উচ্ছ্বসিত আবেগে কাঁদতে লাগলেন। তারপর হযরত কানে কানে আর একটা কথা শুনালেন। এতে ফাতিমা শান্ত হন। হযরত আয়িশা (রাদিঃ) অবাক হয়ে বাপ-মেয়ের কান্না-হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। ফাতিমা (রাদিঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স.) এর রহস্য ব্যক্ত করব না।
অবশ্য পিতা ওফাতের পর তিনি ছোট মাকে জানিয়েছিলেন : বাবা আমাকে সংগোপনে বলেছিলেন যে, ঐ রোগেই তার ইন্তেকাল হবে। এটা ছিল আমার কান্নার কারণ। পরক্ষণে জানালেন : পরিজনের মধ্যেই সর্বপ্রথম আমি তাঁর সঙ্গে মিলব। এটাই ছিল আমার সান্ত¡না প্রাপ্তির কারণ। উল্লেখ্য, সেদিনের ভবিষ্যৎ বাণী মহানবীর ওফাতের বেলায় যেমন সত্যি হয়েছিল, ফাতিমার ওফাতের বেলায়ও তা সত্যি হয়েছিল।
তিনি তার প্রিয়তম পিতার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলেন মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে, হুজুর (স.) এর তিরোধানের শুধু দুই মাস ব্যবধান। সফর মাস ফুরিয়ে এলো রবিউল আউয়াল মাস। কিন্তু মহানবী (স.) আর পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেননি। বিদায়লগ্নের সব আলামতই যেন ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠল।
৬৩২ খ্রিঃ/ ১২ রবিউল আউয়াল ১১ হিজরি তারিখে নূর নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর ওফাত সংঘটিত হয়। এর আগের মাস ২৮ তারিখ সিরিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে সংবাদ পেয়ে নবীজী হযরত মুহাম্মদ (স.) মুসলমানদের সিরিয়া অভিযানে যেতে আদেশ প্রদান করেন। পরদিন নবীজী এক ব্যক্তির জানাজার নামাজ হতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করছিলেন।
পথিমধ্যে তিনি মাথার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লেন। পথ চলতে পারছেন না দেখে হযরত আলী (রাদি.) এবং হযরত আব্বাস (রাদি.) দুজনে নবীজীর দুই বাহু ধরে তাঁকে বিবি আয়েশা (রাদি.) এর প্রকোষ্ঠে পৌঁছে দেন।
বিবি আয়েশা (রাদি.) বলেন, রোগাক্রান্ত হলে নবীজী যে দোয়া পাঠ করে নিজের হাতে ফুঁক দিয়ে সেই হাত দিয়ে শরীর মুছে নিতেন, আমিও সেই দোয়া পাঠ করে নবীজীর হাতে ফুঁক দিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল তারই হাত দিয়ে তাঁর শরীর মুছে দিব। কিন্তু তিনি হাতখানি পশ্চাতের দিকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা কর এবং তোমার সান্নিধ্য দান কর।’ অসুখের দ্বিতীয় দিবস সোমবার নবীজীর জ্বর হয়।
সে সময় পেটেও তিনি যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকেন। তিনি বলেন, খাইবারে ইহুদী মেয়েটি তাঁকে যে বিষ খাইয়েছিল এটা সেই বিষের যন্ত্রণা। চতুর্থ দিবস বুধবার যন্ত্রণা লাঘবের জন্য তাঁর মাথায় সাত মোশক পানি ঢালা হয়। এতে তিনি কিছুটা আরামবোধ করেছিলেন।
অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়লেও রাসূল (স.) অন্যান্য দিনের ন্যায় সেইদিনেও মসজিদে গিয়ে নামাজের ইমামতি করেছিলেন। নামাজের পর সমবেত লোকজনকে সম্বোধন করে তিনি বললেন- আমার কবরকে তোমরা পূজা করিও না। নবীগণের কবরকে যারা সিজদার স্থানে পরিণত করে, আল্লাহ তাদের ওপর গজব নাজিল করেন।
‘বন্ধুগণ! আল্লাহ তাঁর এক বান্দাকে দুনিয়ার সমস্ত ধন দৌলত ও সুখ-শান্তি দান করতে চাইলেন। কিন্তু সে তা গ্রহণ না করে আল্লাহকে গ্রহণ করল।’
এটা শুনে বৃদ্ধ আবু বকর (রাদি.) বালকের ন্যায় রোদন করতে লাগলেন। তার এ অবস্থা দেখে সমবেত সাহাবাগণ হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। নবীজী তাঁর ব্যাকুলতা দেখে বলতে লাগলেন- ‘আমি যার বন্ধুত্ব ও অর্থের নিকট অধিক ঋণী, সে আর কেউ নয়- আবু বকরই।
যদি আমার উম্মতগণের মধ্যে কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারতাম, তা হলে তিনি হতেন আবু বকর (রাদি.)। কিন্তু আমার বন্ধুত্বের বুনিয়াদ হলো ইসলাম এবং বন্ধুত্বের জন্য এটাই যথেষ্ট। প্রেম ও ভক্তির দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে আমি নিশ্চয়ই আবু বকরকে শ্রেষ্ঠ বলে জানি। এই মসজিদের দিকে একমাত্র আবু বকর ছাড়া অপর কারও দরজা যেন খোলা না রাখা হয়।
এ স্থলে এটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, নবীজীর এই ইঙ্গিতের তাৎপর্য অনুধাবন করে তাঁর ইন্তেকালের পর সকলে এক বাক্যে হযরত আবু বকর (রাদি.). কে খলিফা নির্বাচিত করেছিলেন।
(আগামী শুক্রবার সমাপ্য)
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব