ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

বাঙালির ইলিশ বিলাসিতা

ফয়সাল বিন লতিফ

প্রকাশিত: ২১:১৭, ২৯ আগস্ট ২০২৪

বাঙালির ইলিশ বিলাসিতা

বাঙালির ইলিশ বিলাসিতা

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এটি খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর একটি মাছ। সববয়সী মানুষের কাছে মাছটি সমান জনপ্রিয়। ইলিশ নিয়ে বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, আদিখ্যেতা এবং বাড়াবাড়ি অন্য যে কোনো মাছের তুলনায় বেশি। মৌসুমে জেলেদের জালে ইলিশ মাছ ধরা না পড়লেও সেটি যেমন শিরোনাম হয়। তেমনি ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ ধরা পড়লেও হয় শিরোনাম।

যেখানে ২০ কেজি ওজনের অন্য কোনো মাছ ধরা পড়লেও শিরোনাম হয় না সহজে। কিন্তু দুই কেজি ওজনের ইলিশ ধরা পড়লেই সেটি খবরে আসে। সর্বোপরি রাজনীতি, সামাজিক, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে বাঙালির ইলিশ চর্চা। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এ মাছটি ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে ইলিশের সবচেয়ে বড় আধার বাংলাদেশ।

বৈশ্বিক ইলিশ আহরণের ৭০ শতাংশই হয় বাংলাদেশে। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। জিডিপিতে  ইলিশের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় ইলিশ মাছকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশকÑ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে  আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষ। ১৫ বছর আগে যেখানে দেশের ২১টি উপজেলা থেকে ইলিশ পাওয়া যেত, সেখানে বর্তমানে দেশের ১২৫টি উপজেলা থেকে জেলেরা তা আহরণ করছেন।

একটি ইলিশের আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর হয়ে থাকে। ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগই ৩০-৪০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোর্তা ) ইলিশ সারা জীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠাপানি ও লোনা পানিতে জীবন অতিবাহিত  করে।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় দেশের অধিকাংশ মানুষ কি ইলিশের স্বাদ পায়? সরবরাহ বাড়লে দাম কমবেÑঅর্থনীতির এই সহজ সূত্রটি ইলিশের বাজারে গিয়ে ব্যর্থ হয়। ভরা মৌসুমে বাজারে যোগান ভালো থাকলেও ইলিশ কখনোই গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয় সীমার নাগালে থাকে না। নি¤œ-মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের রান্নাঘরেও ইলিশের সুবাস ছড়ায় না। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় ইলিশ মাছ নিয়ে হা-পিত্যেসের শেষ নেই স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে।

ভরা মৌসুমেও ১ কেজি আকারের ইলিশ কিনতে গুনতে হচ্ছে অন্তত দেড়-দুই হাজার টাকা। ইলিশের দাম শুনে শ্রমজীবী মানুষের দামাদামি করার সাহসই হয় না। হতাশ হয়ে ফিরে আসছে বাজার থেকে এবং এর প্রতিকার চাওয়ার সাহসও পায় না। অপরদিকে সচ্ছল মানুষেরাও ভরা মৌসুমে চাহিদার অতিরিক্ত ক্রয় করে মজুত করে রাখে। যাতে করে সারা বছর খেতে পারে। এতে একদিকে যেমন ইলিশের চাহিদা থাকে তুঙ্গে, অন্যদিকে ইলিশ ব্যবসায়ীরাও দাম হাঁকিয়ে থাকে আকাশচুম্বী। ফলে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
স্বল্প আয়ের মানুষদের সন্তানরা বইতে হয়ত পড়েছে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। কিন্তু তাদের কতজন বছরে অন্তত এক পিস ইলিশ মাছ খেতে পারে। সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন? সম্প্রতি মাদ্রাসা পড়ুয়া এক শিশু শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ কি জিজ্ঞেস করা হলেÑ তার উত্তর ছিল পাঙ্গাশ। সেই অবুঝ বালকটি হয়ত মাছ বলতে পাঙ্গাশ মাছকেই চেনে। ইলিশ হয়ত সে দেখেইনি।
যে মাছকে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ বলা হয়, সেই মাছ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ খেতে পারে নাÑসেটি কি বাজার ব্যবস্থার ত্রুটি নয়? আড়তদাররা ইলিশ মাছের দাম সব সময়ই উঁচুতে তুলে রাখেন। মাছের সরবরাহ বেশি থাকলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সব সময় সংকট জিইয়ে রাখেন। অধিকাংশ ব্যবসায়ী মাছ আহরণের খরচকে এর পেছনে দায়ী মনে করছেন।

যেখানে আগে ট্রলারপ্রতি খরচ হতো ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা, সেখানে এখন খরচ হচ্ছে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা এবং ক্ষেত্রবিশেষ আরও অনেক বেশি। এ ছাড়াও মা ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশে যখন ৬৫ দিনের অবরোধ চলে, তখন বাংলাদেশী জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারে না। অথচ নিষিদ্ধ সময়ে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। ফলে দেশীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় ট্রলার আটকের খবরও গণমাধ্যমে দেখা যায়। এর জন্য প্রয়োজন যৌথ দেশের কূটনৈতিক সমাধান। যেমনÑদুই দেশে একই সময়ে মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময় নির্ধারণ করা, ইলিশের প্রজনন ও যাতায়াতের সুরক্ষিত পথ নিশ্চিত করা, ইলিশ সুরক্ষায় যৌথ দেশের আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
কেন ইলিশ মাছ বছরের কোনো একটি সময়ে এসেও সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে আসে না, এর জন্য গবেষণা শুরু হওয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী। পুকুরে ইলিশ চাষ করা যায় কি না; টিনজাত করে ইলিশ বিক্রি করা যায় কি না- এ রকম গবেষণাও চলছে।

বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান মনে করেন- বাজারে ইলিশ মাছ কেটে পিস পিস করে বিক্রি করা যেতে পারে। অর্থাৎ যার একটি ইলিশ কেনার সামার্থ্য নেই, তিনি তার প্রয়োজনমতো পিস কিনে পরিবার নিয়ে যেন খেতে পারেন।
বর্তমান মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ১১ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইলিশ নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশের মানুষ যাতে ইলিশ মাছ পায় এবং দাম কমে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেশের মানুষ ইলিশ পাবে না আর রপ্তানি হবে, সেটা হতে পারে না। তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।

একই সঙ্গে তাকে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের মাধ্যমে সকল সিন্ডিকেট ধ্বংস করে মাছ বাজারের অস্থিরতাকে কমিয়ে আনতে হবে।
বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ইলিশ। মাছটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে দূষণ ও দখল থেকে নদীকে রক্ষা করতে হবে। ইলিশ খুব সংবেদনশীল একটা মাছ। তার প্রজনন, টিকে থাকা এবং বেড়ে ওঠার মতো পরিবেশ না থাকলে মাছটি বিলুপ্ত মাছে পরিণত হতে পারে একদিন। এজন্য ইলিশকে তার চেনা পথে চলতে দিতে হবে।

বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের নদী, নালা, খাল-বিলকে। তা না হলে বেশি টাকা দিয়েও ইলিশ মাছ পাওয়া সম্ভব হবে না। সারা বছর না হোক, ভরা মৌসুমে হলেও যেন গরিব-মধ্যবিত্ত সবাই ইলিশের স্বাদ পেতে পারে সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা

×