ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইতিহাসে ফেরাউনের স্ত্রী হজরত আছিয়া (আ.)

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৪২, ১৫ আগস্ট ২০২৪

ইতিহাসে ফেরাউনের স্ত্রী হজরত আছিয়া (আ.)

প্রসঙ্গ ইসলাম

(গত শুক্রবারের পর) 

আছিয়া এসবের কিছুই জানতেন না। ফেরাউনের দুর্দম শক্তির মোকাবিলায় মূসা (আঃ) কী হাতিয়ার ব্যবহার করবেন, কার থেকে সাহায্য নিবেন তাও তার অজ্ঞাত ছিল। তিনি মূসা (আঃ) ও হারুন (আঃ) এর আগমন সংবাদ শুনে ভাবনায় পড়ে গেলেন যে,  ফেরাউনের কাছে তারা বলবেটা কী? আর কিভাবেই বা বলবে? কাছাকাছি থাকার কারণে স্বামীর নিষ্ঠুর স্বভাব সম্পর্কে তিনি খুব ভালভাবেই ওয়াকিফহাল।

এই ভাবনা ও দুর্ভাবনায় তিনি ডুবে ছিলেন হঠাৎ কানে আওয়াজ এলো, মূসা (আঃ) রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করছেন। অল্পক্ষণ পরেই তিনি সবার সামনে এক মহাসত্যের পয়গাম তুলে ধরবেন। তাদের কথাবার্তা শোনার জন্য আছিয়া দরবারের একপাশে বেলকনিতে আসন গ্রহণ করলেন। 
আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের জন্য মূসা (আঃ) অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে সহোদর ভাই হারুন (আঃ)ও। তাদের প্রতি আল্লাহর আদেশ ছিল। তোমরা ফেরাউনের কাছে গিয়ে বলবে, ‘আমরা তোমার প্রভুর প্রেরিত পয়গাম্বর। তোমার অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতনের হাত থেকে বনী ইসরাঈলকে মুক্ত করার জন্যই আমরা এসেছি। বনী ইসরাঈলকে আমাদের সঙ্গে যেতে দাও। তাদেরকে অযথা নির্যাতন কর না। - সুরা ত্বহা, আয়াত ৪৭। পাশেই গ্যালারি থেকে আছিয়া মনোযোগ সহকারে দরবারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। 
ফেরাউন কথাটিকে কোনোই গুরুত্ব দিল না। উল্টো সে গোস্বা ভরে বলল, মূসা! আজ তুমি আমাকে এ কথা বলছ? আমি কি তোমাকে লালন করিনি? বছরের পর বছর আমার ঘরে খেয়েপরেই তুমি বড় হয়েছ। দূর থেকে আছিয়া অত্যন্ত আগ্রহভরে মূসা (আঃ) এর কথা শুনছিলেন। তিনি দেখলেন  ফেরাউন ক্রোধান্বিত হয়ে উঠছে। এটা চরমে উঠতে হয়তো খুব বেশি সময় লাগবে না।

কিন্তু মূসা (আঃ) নির্বিকার ভঙ্গিতে মুহূর্তেই এক সাংঘাতিক বাক্য নির্মাণ করলেন। আরে! বাল্যকালে আমার লালনপালনের অনুগ্রহের কথা বলে আমাকে আপনি খোটা দিচ্ছেন? শুনুন! এটা ছিল আপনার বর্বরতা আর পাষণ্ডতার আরেক ইতিহাস। যদি আপনার পাশবিকতা সীমা ছাড়িয়ে না যেত তাহলে নিজ ঘরেই আমি সুখে শান্তিতে প্রতিপালিত হতাম, এখানে আসার পরও তো আমার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল।

আল্লাহ পাকের সীমাহীন মেহেরবাণীই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অন্যথায় আপনার অভিপ্রায় তো ছিল অন্য কিছু। আপনার প্রাসাদে আমার প্রতিপালিত হওয়াও কি বনী ইসরাঈলের ওপর অমানবিক অত্যাচারের প্রমাণ বহন করে না?
এ কথা শুনে ফেরাউন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে বলতে লাগল, ইতোপূর্বে তুমি আরও অনেক কিছু করেছ। আমাদের নিরপরাধ একজন লোককে হত্যা করেছ। আর এখন আমাদের অবদানকে অস্বীকার করছ? মূসা (আঃ) বললেন, ঐ কাজটি তো একান্তই আমার অনিচ্ছায় সংঘটিত হয়েছে। পরে আপনাদের ভয়ে আমি দেশ ছাড়াও হয়েছিলাম। এখন তো রাব্বুল আলামীনের রহমত ও  নেয়ামতে আমি অভিষিক্ত।

জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মহাসম্পদ তিনি আমাকে দান করেছেন। আমাকে তিনি তাঁর পয়গাম্বর বানিয়েছেন। অল্প সময় গম্ভীর থেকে কিছুটা অবজ্ঞার সুরে  ফেরাউন বলল, তোমাদের রাব্বুল আলামীন আবার কে? জবাবে মূসা (আঃ) বললেন, যদি আপনি নিজের চারপাশের সৃষ্টিজগত নিয়ে একটু গভীর চিন্তা করেন, পৃথিবীর গতি প্রকৃতি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন, এমনকি নিজের জীবন ও এর সুশৃঙ্খল প্রবাহ নিয়ে, ভোগ বিলাসের সমূহ সম্ভার নিয়ে সুষ্ঠুভাবে একাগ্রচিত্তে একটু ধ্যানমগ্ন হন তাহলে আপনি নিজেই উপলদ্ধি করতে পারবেন রাব্বুল আলামীন হচ্ছেন আসমান জমিন ও এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু আছে সবার সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক।
এ জবাব শুনে ফেরাউনের ক্রোধ কয়েকগুণ বেড়ে গেল। তার আওয়াজে ক্ষিপ্রতা এসে গেল। দরবারের কথাবার্তা শুনে আছিয়া নিজ কামরায় ফিরে এসে বলতে লাগলেন মূসার ওপর এবং যে দ্বীনের দাওয়াত তারা নিয়ে এসেছে আমি তার ওপর পূর্ণ ইমান আনলাম। রাব্বুল আলামীনের সমীপে নিজেকে সর্বতোভাবে সমর্পণ করলাম।

এ দিকে ফেরাউনের বিকট আওয়াজ দরবার ছাড়িয়ে বাইরে এসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সে বলছে, তোমরা কি এর কথা শুনছ? এদের জিজ্ঞেস কর, কাকে তারা প্রভু মানে, তাদের রব কে? মূসা (আঃ) বললেন, যিনি আপনাদের ও আপনাদের পূর্বপুরুষের প্রভু, তিনিই আমাদের প্রভু। নিখিল পৃথিবী ও এর মধ্যকার সবকিছুর যিনি ¯্রষ্টা তিনিই আমাদের রব।

ফেরাউন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, যদি আমি ভিন্ন অন্য কাউকে তোমরা মাবুদ মনে কর তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের কঠিন শাস্তির সম্মুখীন করব। একান্ত ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে প্রশান্ত চিত্তে মূসা (আঃ) বললেন, যদি আমার দাবির পক্ষে সুস্পষ্টত কোনো দলিল কিংবা অলৌকিক কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারি তাহলে কি আমার কথার সত্যায়ন আপনারা করবেন? তারপরেও কি আপনাদের মনের অমূলক সন্দেহ সংশয় দূর হবে না। ফেরাউন বলল, আচ্ছা তুমি যদি নিজ দাবিতে সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে আমাদের কোনো মুজিযা দেখাও।
আছিয়া আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছেন। এবার তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবতে লাগলেন মূসা কি কোনো জাদুকর? নাকি সত্যিই সে একজন মুজিজাধারী যে তার স্বেচ্ছাচারী স্বামীর অহংকার ও দম্ভকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারবে। তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন, মূসা! তুমি যদি জাদুকর হয়ে থাক তাহলে কস্মিনকালেও বিজয়ের নাগাল পাবে না তুমি। এরাই বিজয়ী হবে। এদের ঔদ্ধত্য বেড়ে যাবে আরও কয়েকগুণ। 
আছিয়ার ভাবতন্ময়তা কাটতে না কাটতেই তিনি দেখতে পেলেন মূসা (আঃ) তার হাতের লাঠিটি বৃত্তাকারে হাওয়ায় ভাসিয়ে জমিনে  ছেড়ে দিলেন। কোনো আওয়াজ হলো না ঠিকই কিন্তু বিশালকায় এক অজগরে পরিণত হলো লাঠিটি। প্রকা- মাথাটি উঁচুতে তুলে বিষাক্ত দাঁতগুলো বের করে সে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল।  ফেরাউন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। সাপটি এমনভাবে ফেরাউনের দিকে এগুতে লাগল যেন, এক্ষুণি তাকে গিলে খাবে।

ফেরাউন আত্মসংবরণ করে বলল, মূসা! তোমার সামর্থ্য কি এটুকুই। নাকি আরও কোনো ভেল্কি তোমার ভা-ারে আছে? মূসা (আঃ) নিজের ডানহাত বাম বগলের নিচে থেকে বের করে প্রলম্বিত করে মেলে ধরলেন। অপরূপ শুভ্র জ্যোতির বিচ্ছুরণ শুরু হলো সেখান থেকে। রশ্মির তীব্রতায় সকলের চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার উপক্রম। 
এসব কল্পনাতীত বাস্তবতা চাক্ষুষ দেখতে পেয়ে আছিয়া বলতে লাগলেন, নিশ্চয় আল্লাহ পাক মূসাকে সহায়তা করবেন। তাকে বিজয়ী আর ফেরাউনকে পরাজিত করবেন। কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছিল তার হৃৎপিণ্ডে। তবুও তিনি আশান্বিত হয়ে উঠলেন- হয়তো এবার তার স্বামীর মনে ভীতির সঞ্চার হবে। মূসা (আঃ) এর দাওয়াতের সামনে মাথানত করবে সে।

নিজের জুলুম নির্যাতনের ঘৃণ্য পথ থেকে ফিরে আসবে। কৃত্রিম প্রভুত্বের অন্ধ অহমিকার ফেরাউন মাঝে মাঝে তুলকালাম কা- ঘটিয়ে ফেলত। আর তার নির্মমতার বলি হতো বেচারা বনী ইসরাঈল। সব কিছুর পরও আছিয়া এবার আশান্বিত।
কিন্তু তার আশা ব্যর্থ হতে বেশি সময় লাগল না। ফেরাউন তার সভাসদকে সম্বোধন করে বলল, তোমরা জেনে রাখ, মূসা ও তার ভাই হচ্ছে আস্ত জাদুকর। জাদু বলে তারা তোমাদের ভূখ- থেকে বের করে নিতে চায়। তোমাদের করণীয় সম্পর্কে তোমরাই এবার সিদ্ধান্ত নাও। জনৈক মন্ত্রী পরামর্শ দিল বাদশাহ সালামত! মূসা ও তার ভাইয়ের জাদুর যথোচিত জবাব দেওয়া দরকার। আপনি সমগ্র মিসরে আপনার প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিন।

তারা দেশের সব অভিজ্ঞ জাদুকরকে আপনার দরবারে এনে উপস্থিত করবে। পরামর্শটি ফেরাউনের খুবই মনঃপুত হলো। সে দেশের চতুর্দিকে থেকে জাদুকরদের একত্রিত করায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। আছিয়া জাদুকরদের তেলেসমাতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতেন। কাজেই মূসা (আঃ) কে নিয়ে তিনি মহাভাবনায় ডুবে গেলেন। আছিয়া তাদের নিন্মোক্ত বক্তব্যটি নিয়েও বিস্তর ভাবতে থাকলেন : আমাদের এ মর্মেও ওহী পাঠানো হয়েছে যে, যারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং সঠিক দ্বীন থেকে বিমুখ হয়ে যায় তাদের ওপর আল্লাহর আজাব অবধারিত। –সুরা ত্ব-হা, আয়াত ৪৮।
এসব কথাবার্তা নিয়ে গভীর চিন্তা ভাবনা করে আছিয়া মূসা (আঃ) এর অকপট উপস্থাপন ও সাবলীল বর্ণনাভঙ্গিতে বেশ চমৎকৃত হলেন। কত ছোট্ট অথচ পূর্ণাঙ্গভাবে তিনি মহান প্রভুর গুণাবলীর পরিচয় তুলে ধরে বলেছিলেন : আমাদের পালনকর্তা তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথপ্রদর্শন করেছেন। সুরা ত্ব-হা, আয়াত ৫০।
আছিয়া মূসা (আঃ) এর সব কিছুর ওপর ইমান এনে মনে মনে ফেরাউনকে বললেন, মূসার সঙ্গে বিতর্কে তুমি হেরে গেছ। বিশেষ করে যখন তুমি মূসাকে বলেছিলে, তাহলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কি? আর তৎক্ষণাৎ মূসা এর যুৎসই উত্তর দিয়ে বলেছিল, তাদের খবর আমার পালনকর্তার কাছে লিখিত আছে। আমার পালনকর্তা ভ্রান্ত হন না এং বিস্মৃতও হন না।
তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে শয্যা করেছেন এবং তাতে চলার পথ করেছেন, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন এবং তা দ্বারা আমরা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি। তা থেকে তোমরা আহার কর এবং তোমাদের চতুষ্পদ জন্তু চরাও। নিশ্চয় এতে বিবেকবানদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। সুরা ত্ব-হা, আয়াত ৫২ ও ৫৪। 
গভীর ভাবনার সীমানা পেরিয়ে এভাবে ইমানের ভূখ-ে ঢুকে পড়লেন আছিয়া। নারীদের মাঝে তিনিই সর্ব প্রথম মূসা (আঃ) এর ওপর ইমান আনেন।
(সমাপ্ত)

লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×