ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

পেট্রোডলার এবং বাংলাদেশের স্বর্ণ রিজার্ভ

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২০ জুন ২০২৪

পেট্রোডলার এবং বাংলাদেশের স্বর্ণ রিজার্ভ

পেট্রোডলার এবং বাংলাদেশের স্বর্ণ রিজার্ভ

বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র মোড়লগিরি এখন অধিকাংশ দেশের কাছেই চক্ষশূলে পরিণত হয়েছে। নিজ দেশের মুদ্রা ডলারকে ‘নিষেধাজ্ঞা’ নাম দিয়ে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করায় কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রিজার্ভে ডলার ক্রমশই প্রাধান্য হারাচ্ছে। একের পর এক দেশ বাণিজ্য ও রিজার্ভের ক্ষেত্রে ডলারনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসছে বা আসার চেষ্টা করছে। যদিও ডলারের বিকল্প হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো দেশের মুদ্রা এককভাবে উঠে আসেনি। তবে ইউয়ান, রুবল ও ইয়েনের ব্যবহার পাল্লা দিয়ে বেড়েছে; এসব মুদ্রার বিনিময় হারও বাড়ছে

চলতি মাসের মাঝামাঝি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে  অনুষ্ঠিত সেন্ট পিটার্সবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ফোরাম (এসপিআইইএফ) শীর্ষ সম্মেলনে ১৪০টিরও বেশি দেশের শীর্ষ নীতিনির্ধারক ও সরকারি-বেসরকারি অর্থনীতি ও বাণিজ্য প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে পরিবর্তন এবং ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়ে গেছে।

এই সম্মেলনে যোগ দেওয়া অনেক বিদেশী প্রতিনিধি অবাক বিস্ময়ে রাশিয়া গিয়ে দেখলেন, বিশ্বের সর্বাধিক পারমাণবিক বোমা ক্ষমতার অধিকারী  প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের রাশিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সবুজাভ রঙা আমেরিকান ডলারের কোনো বিনিময় মূল্য নেই। অথচ অনেক দেশের সরকারের আর্থিক লেনদেনে স্বীকৃতি অর্জন না করা ক্রিপ্টোকারেন্সি। গুপ্তমুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো বাইনারি উপাত্তের একটি সংকলন, যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এর অস্তিত্ব শুধু ইন্টারনেট জগতেই বিদ্যমান।

এটি ব্যবহার করে লেনদেন শুধু অনলাইনেই সম্ভব, যার পুরো কার্যক্রম গুপ্তলিখন নামে সুরক্ষিত একটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সাল থেকে এটি একটি উঠতি বাজারে পরিণত হয়েছে, যার আকার বর্তমানে ১০৬ ট্রিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক পুঁজিবাজারের ২ দশমিক ৫ শতাংশ বা ২ দশমিক ৬৭ ট্রিলিয়ন ডলারের। গুপ্ত এই মুদ্রা দিয়ে বিশ্বের যেকোনো দেশে বসে এখন যেকোনো দেশে যাওয়ার বিমানের টিকেট ও পণ্যসামগ্রী কেনা যায়। বিশ্বে^র অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ায় মার্কিন ডলারের মূল্যহীনতা ও অনাস্থার এই ধারা খুব ধীরে হলেও অন্য অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

বিশ্ব মুদ্রাবাজারের অনিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে নিজ অর্থনীতিকে রক্ষা করতে বিশ্বের অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে স্বর্ণ বা সোনার মজুত বাড়াচ্ছে। কারণ, একটি দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে, নাকি কোনো বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তা নির্ধারণে সোনার মজুত বিশেষ ভূমিকা রাখে। হাজার হাজার বছর ধরেই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় স্বর্ণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৮ শতকের শেষের দিকে ও পরবর্তী শতকের উল্লেখযোগ্য সময়জুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার স্বর্ণমানকে বিনিময়ের হিসাবমাধ্যম ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছিল, যা ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্তে ভ-ুল হয়ে যায় এবং বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটাই মার্কিন ডলারের গোলামে পরিণত হয়।

তবে এখন আবার স্বর্ণমানের অতীত ধারা ফিরে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভৃত্যরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের কমবেশি সব দেশই নীরবে স্বাগত জানিয়ে নানা উপায়ে স্বর্ণের মজুত বাড়াচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আন্তঃমুদ্রা বিনিময় প্রথার প্রচলন ঘটাচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে বর্তমানে কিছুটা চাপে থাকা বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির বাংলাদেশকে স্বর্ণের মজুত বাড়াতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে না দেখা গেলেও বোঝা যাচ্ছে, নীতিনির্ধারকরা বিশ্ব মুদ্রাবাজারের চলমান অস্থিরতার দিকে সতর্ক নজর রাখছেন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশকেও ডলারনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে উদ্যোগী হতে হবে।

স্বর্ণের মজুত বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। চলতি জুন পর্যন্ত বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা মজুতের তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে সোনার মজুত রয়েছে ১৪ দশমিক ৫ মেট্রিক টন, যা বিশ্বে ৬৬তম। 
বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র মোড়লগিরি এখন অধিকাংশ দেশের কাছেই চক্ষশূলে পরিণত হয়েছে। নিজ দেশের মুদ্রা ডলারকে ‘নিষেধাজ্ঞা’ নাম দিয়ে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করায় কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রিজার্ভে ডলার ক্রমশই প্রাধান্য হারাচ্ছে। একের পর এক দেশ বাণিজ্য ও রিজার্ভের ক্ষেত্রে ডলারনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসছে বা আসার চেষ্টা করছে। যদিও ডলারের বিকল্প হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো দেশের মুদ্রা এককভাবে উঠে আসেনি।

তবে ইউয়ান, রুবল ও ইয়েনের ব্যবহার পাল্লা দিয়ে বেড়েছে; এসব মুদ্রার বিনিময় হারও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বিনিময়ে প্রধান মুদ্রা মার্কিন ডলারের কোণঠাসা হয়ে পড়ার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবও যোগ দিয়েছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ- চাপ  ও অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, গত ৯ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকা দীর্ঘ ৫০ বছরের পেট্রোডলার চুক্তি আর নবায়ন করা হবে না। সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তকে অর্থনীতি বিশ্লেষকরা ডলারের ওপর মরণাঘাত হিসেবে অভিহিত করছেন।

তারা বলছেন, সৌদি এই সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লেনদেনে ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য অনেকটাই খর্ব হবে।  বিশ্বে মার্কিন ডলারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই চুক্তি সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিল। চুক্তি অনুসারে পেট্রোডলার থেকে যে রাজস্ব আদায় হতো, তা যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠাতে হতো সৌদি আরবকে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, সত্তরের দশকের শুরুর দিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের দাম আচমকা নেমে যেতে শুরু করে। এ সময় জ্বালানি তেলেরও সংকট দেখা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে।

এমন অবস্থায় ১৯৭৩ সালে মিসর ও সিরিয়ার নেতৃত্বে আরব দেশগুলো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এতে ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্য দেশগুলো। পাশ্চাত্যের শক্তিতে বলীয়ান ইসরাইলের সঙ্গে ছয় দিনের ওই যুদ্ধে আরব দেশগুলোর পরাজয় হয়েছিল। ইসরাইলের পক্ষ নেওয়ায় খনিজ তেলের বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনেক বিধি-নিষেধ আরোপ করে সৌদি নেতৃত্বাধীন পশ্চিম এশিয়ার তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো।

এতে যুক্তরাষ্ট্রের খনিজ তেল সংকট আরও বেড়ে যায়। এ সময় ইসরাইল ও ইরানের আক্রমণের ভয় দেখিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে পেট্রোডলার চুক্তি স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, সৌদিদের কাছ থেকে তেল কিনবে যুক্তরাষ্ট্র। পরিবর্তে সৌদিকে তারা সামরিক সহায়তা দেবে। এ ছাড়া অন্য যেকোনো দেশের কাছে খনিজ তেল বিক্রিতে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে একমাত্র ডলারকেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। ৫০ বছরের ওই চুক্তির মেয়াদ এ মাসে শেষ হয়েছে। 
এদিকে তেল উৎপাদক প্রধান প্রধান দেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের ইউয়ানকে মান্যতা দিলে ডলারের আধিপাত্য হ্রাস অনেকটাই নিশ্চিত হবে বলে অনেকে মনে করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর পাশ্চাত্য দেশগুলোর সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার চরম বিরোধের মধ্যেই তাইওয়ান নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের উত্তেজনা এখন চরমে পৌঁছেছে। কট্টর পশ্চিমাপন্থি তাইওয়ানিজ সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দহরম-মহরম চীনের ক্ষোভ বাড়াচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও তকার মিত্ররা রাশিয়া ও চীনের ওপর একের পর এক প্রযুক্তি ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। ফলে, সামরিক সংঘাতকে বাদ দিলে একমাত্র আর্থিক যুদ্ধের রাস্তাই খোলা এখন রাশিয়া ও চীনের সামনে। ডলারকে দুর্বল করার উদ্যোগ নিয়ে মস্কো ও বেজিং যুক্তরাষ্ট্রকে উচিত জবাব দিতে চেষ্টা করছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের পাঁচ দেশের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ হাই ভ্যালু কারেন্সি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, চীনের ইউয়ান যার অন্যতম। আইএমএফের কারেন্সি বাস্কেটে ইউয়ান স্বীকৃতি পেয়েছে ২০১৬ সালে। এরপর থেকে সংস্থাটির পর্যালোচনায় মুদ্রা হিসেবে ইউয়ান আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে।

চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও দীর্র্ঘদিন ধরে কমবেশি সমান গতিতে চলছে।  অনেক দেশই তাই চীনের মুদ্রার ওপর ভরসা করতে চাইছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে লেনদেন বাড়ছে। ব্লুমবার্গের ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, রাশিয়ার বাণিজ্যে প্রথমবারের মতো ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে চীনের ইউয়ান। এমনকি চীন-রাশিয়ার বাণিজ্যের ৮০ শতাংশের বেশি হচ্ছে এখন স্থানীয় মুদ্রায়। অনেক দেশই এখন রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের বিকল্প ইউয়ানসহ অন্যান্য মুদ্রাকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

সৌদি আরব ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইউয়ানে তেল বিক্রি করবে। এতে করে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ও আন্তঃবাণিজ্যে ডলারের অবস্থান ক্রমে দুর্বল হচ্ছে। ২০০০ সালে যেখানে বিশে^র বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ মুদ্রার ৭০ শতাংশ ছিল ডলারে, এখন তা কমে ৫২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেনে মার্কিন ডলারের ২০০০ সালের ৬৫ শতাংশ হিস্যা ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ১৫ শতাংশে। তবে এতকিছুর পর মার্কিন ডলারের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এখনো বিশ্বের কোনো মুদ্রাই উঠে আসতে পারেনি।
পেট্রোডলারের সমাপ্তি এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুদ্রার সামনে বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে।  
বিশ্বব্যাপী মুদ্রাবাজারে যুদ্ধ যুদ্ধ বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়ানোকে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারক সবচেয়ে নিরাপদ আর্থিক কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তারা বৈদেশিক রিজার্ভকে বৈচিত্র্যময় করতে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে স্বর্ণকে বিপদের সময় নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করছেন। তারা মনে করেন, স্বর্ণের ভালো মজুত মুদ্রার ওঠানামা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করতে পারে।

এমনিতে ঐতিহাসিকভাবেই বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ঝুঁকি কমাতে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করতে স্বর্ণের মজুত বৃদ্ধিকে গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে বিশ্বাস করে আসছে। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েক বছর ধরে রেকর্ড মাত্রায় সোনা কিনছে। এ সময় স্বর্ণের বড় ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন, ভারত, রাশিয়া, সৌদি আরব, পোল্যান্ডের মতো দেশ। ডলারের গ্রহণযোগ্যতা ও মূল্য হ্রাস প্রবণতা সামনের বছরগুলোয় আরও বাড়বে বলে আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন।

এ ছাড়া বিশ্বের খ্যাতনামা অনেক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিজ্ঞানী সাম্প্রতিক বারংবার বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও আধিপত্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে সর্বোচ্চ ৫০ বছরের মধ্যেই আমেরিকান সভ্যতার (আসলে অসভ্যতা) পুরোপুরি অবসান ঘটবে। তারা বলছেন, ঐতিহাসিক তথ্য দেখায় যে সভ্যতার পালাবদলের সময় স্বর্ণের মতো মূল্যবান ধাতুর দাম সাধারণত স্বল্পমেয়াদি অস্থিরতা সত্ত্বেও দীর্ঘ মেয়াদে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।

এটি মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে স্বর্ণের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে। সোনার দুষ্প্রাপ্যতা এবং অর্থনৈতিক সংকটের সময় বাজারের স্বর্ণের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে এর দামকে প্রভাবিত করতে পারে বলে সব যুগেই বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মূল্যবান এ ধাতুটি প্রাধান্য পেয়েছে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ মাত্র ১৪ দশমিক ৫ টন স্বর্ণের মালিক। বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির একটি দেশের এত কম পরিমাণ স্বর্ণের মজুত ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল নেতিবাচক বলে মনে করছে। কারণ, বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৮ হাজার ১৩৩ দশমিক ৫০ টন সোনা মজুত রয়েছে। ইউরোপের দেশ জার্মানির রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে, প্রায় ৩ হাজার ৩৫৫ টন। জার্মানির পরে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের আরেক দেশ ইতালি।

দেশটির রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৪৫২ টন সোনা। এরপরের তিনটি দেশ হলো যথাক্রমে রাশিয়া, চীন ও সুইজারল্যান্ড। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের সোনার মজুত রয়েছে ৭৯০ টন। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের স্বর্ণ মজুতে অবস্থান ৪৬তম। বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের মজুত বেশি হওয়া ছাড়াও দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৪৪ শতাংশই স্বর্ণ।

অপরদিকে ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিক হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট রিজার্ভের মধ্যে ১৪ দশমিক ৫ টন সোনা, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় ২ শতাংশ। এটি ২০২৩ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিক অবস্থার সমান, যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণের রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ পৌঁছেছিল। স্বর্ণ মজুতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় চতুর্থ এবং বিশ্বব্যাপী ৬৬তম। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২১-২২ অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মজুত সোনার মধ্যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ভল্টে রয়েছে ৫ হাজার ৮৭৬ কেজি, যা মোট সোনার ৪২ শতাংশ।

এ ছাড়া ৪১ শতাংশ রয়েছে লন্ডনের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এইচএসবিসি ব্যাংকে। বাকি ২ হাজার ৩৬২ কেজি সোনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে হামলার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর ব্যাংক ও আর্থিক খাতে রক্ষিত ৩০০ বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ ও আর্থিক সম্পদ জব্দ করে ইউক্রেনের যুদ্ধ খরচ চালাতে ব্যয় করার ধনী ৭ দেশের সংগঠন জি-৭ এর সিদ্ধান্তের পর অনেক দেশই পাশ্চাত্য দেশে স্বর্ণ ও অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখতে দ্বিতীয়বার ভাবছে। সম্পর্কে বৈরিতা সৃষ্টি হলে ওই অর্থ-সম্পদ হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশে স্বর্ণ মজুতের বিষয়টি বাংলাদেশকে পুনরায় ভেবে দেখতে হবে। একই সঙ্গে স্বর্ণের মজুত বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×