ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

শীতের সংস্কৃতি

সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:২০, ২৬ জানুয়ারি ২০২৪

শীতের সংস্কৃতি

.

কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের হালকা হিমেল বাতাস দিয়ে জানান দেয় শীতকাল। কৃষকের মাঠগুলো সোনালি ধানের হাসিতে ভরে ওঠে। শুরু হয় বাঙালির নবান্নব্যাপী। হেমন্ত শীত ঋতু বাঙালির জীবনে অনেক বেশি প্রভার বিস্তার করে অন্য ঋতুর তুলনায়। চারদিকে নতুন ধান দিয়ে নবান্ন উৎসবের আয়োজন এখন বাঙালির সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পলিবিধৌত বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। প্রতিটি ঋতু ভিন্ন মেজাজে, ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে দেশে। ঋতুর সংখ্যাগত পরিক্রমায় শীতের স্থান পঞ্চম। শীতের সঙ্গে উৎসবের একটা গভীর যোগসূত্র রয়েছে। গ্রাম বাংলায়, এমনকি নগরেও উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে শীত। এই উৎসব  একেবারেই লৌকিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এই উৎসবের সঙ্গে দেশের মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শীতকালটা বিশেষ বিশেষ অনুষঙ্গ নিয়ে হাজির হয় প্রতিবছর। তাই এটি আমাদের জন্য বিশেষ হয়ে ওঠে। দৈনন্দিন জীবনে একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে শীতকাল। 

গরম আমাদের বিচ্ছিন্ন করে। আর শীত করে যূথবদ্ধ। মানুষের যূথবদ্ধতা মানেই উৎসব। কোনো উৎসব ছাড়া মানুষ সাধারণত এক জায়গায় মিলিত হয় না তেমন। মানুষের এই যূথবদ্ধতার চিত্র শীতকালে সর্বত্রই চোখে পড়ে। গ্রামাঞ্চলের কুয়াশা ঢাকা ভোরে ঘুমভাঙা মানুষ বাড়ির উঠানে, ঘাটায়, রাস্তার ধারে, চা দোকানের মাচায়, পুকুর বা নদীর পারে যূথবদ্ধ হয়ে রোদ পোহাতে বসে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবা, বুড়ো-বুড়ি সবাই। মিষ্টি রোদের ওম নিতে নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেতে থাকে নানা গল্পগুজবে। গ্রামবাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির যত আয়োজন, সবই অনুষ্ঠিত হয় শীতের রাতে। যেমন-কবিগান, জারিপালা, মুর্শিদিগান, মাঘীপূর্ণিমা, মানিক পীরের গান, পতুলনাচ, মাদার বাঁশের জারি, মাইজভা-ারি গান ইত্যাদি। কুয়াশার রাতে যতই ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি থাকুক, যাত্রাপালা শুনতে যাওয়াকে কি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারে! শীতের রাতে নানা ধরনের নাট্যগীতের আয়োজনে মুখর হয় গ্রামবাংলা। শীতকালজুড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গাজীর গীত, মানিক পীরের গীত, মাদার পীরের গীতসহ বিভিন্ন ধরনের যাত্রাপালা অভিনীত হতে দেখা যায়। কোনো কোনো যাত্রাপালা অভিনীত হয় গ্রামের সাধারণ মানুষেরই উদ্যোগে। তাদেরই অভিনয়ে শখের যাত্রাপালা হিসেবে। গ্রামের সাধারণ কৃষক, কামার, কুমার, মুটে, ভ্যানচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ নিজেরাই শীতের প্রথম দিকে মহড়া দিয়ে যাত্রায় অভিনয় করে থাকে। অন্যদিকে, কিছু পেশাদার যাত্রার দল পেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে শীতকালজুড়ে পরিবেশন করে যাত্রাপালা। শীতের সঙ্গে সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসবের সংযোগ রয়েছে বৈকি।

শীতকালে পরিবর্তন ঘটে খাবার তালিকায়ও। আবির্ভাব ঘটে কিছু নতুনত্বের, যা শুধু শীতের ঐতিহ্যই বহন করে না, আনন্দও জোগায়। শীতকালে গ্রামের ঘরে ঘরে নতুন ধান ওঠে। বাঙালির লোকজ ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠা-পুলি ভূমিকা প্রাচীনকাল থেকেই। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর বা সন্ধ্যায় গ্রামের বধূরা পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করে। হরেক রকমের রসনাজাতীয় পিঠা-পায়েস দিয়ে গ্রামের মায়েরা ব্যস্ত হয়ে পরে নতুন জামাইকে আদর-আপ্যায়ন করাতে। একসময় গ্রামে-গঞ্জে মেয়েদের নতুন বিয়ের পর শশুড়বাড়িতে গুড়-মুড়ি-চিড়ে, পান-সুপারির সঙ্গে পাঠানো হতো বিশাল ডালাভর্তি অথবা রঙিন হাঁড়িভর্তি ফুলপিঠা, পাকনপিঠা। কালের আবর্তে এখন আর সে সংস্কৃতি প্রায় নেই। তবে এখন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই সাবলীল থাকার কারণে চলে বিয়েশাদি, সুন্নতে খতনা, ওয়াজ মাহফিল, বর-কনের গায়ে হলুদ, মুখে ভাত, অষ্টপ্রহর কীর্তন, পিঠা উৎসব, অতিথি আগমনের অনুষ্ঠান। বর্তমান সময়ে দেশের প্রায় জায়গায় অনুষ্ঠিত হয় বর্ণিল পিঠা উৎসব। এসব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে থাকে পিঠাপুলির ব্যবহার। আত্মীয়স্বজন পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনকে আরও মজবুত করতে মুখরোচক রসে টইটম্বুর পিঠাপুলির উৎসব বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

প্রত্যেক দেশেরই ঐতিহ্যবাহী কিছু মিষ্টান্ন থাকে, যা তাদের খাদ্য সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশ বাঙালির ক্ষেত্রে তা নিঃসন্দেহে পিঠা। পিঠা শুধু আমাদের জন্য লোকজ খাবারই নয়, পিঠা আমাদের বাঙালির স্মৃতি লোকজ সংস্কৃতির ভা-ার, ঐতিহ্যও বটে। প্রাচীন বাংলায় মিষ্টান্ন হিসাবে পিঠার জনপ্রিয়তাই ছিল সবচেয়ে বেশি। দেশে শীত মানেই আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি পিঠা-পুলির উৎসব। শীত মানেই গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাপাপিঠা, পিঠাপুলি, ক্ষির-পায়েস খাওয়ার ধুম। শীতের পিঠাপুলির গোড়াপত্তন গ্রামে হলেও এটি বাঙালির শিকড়ের আদি ঐতিহ্য। বর্তমান সময়ে অনেক পিঠা আছে, যা সারাদেশেই জনপ্রিয়।

এগুলো হচ্ছে- ভাপাপিঠা, চিতইপিঠা, ঝালপিঠা, ছাঁচপিঠা, ছিটকাপিঠা, দুধচিতই, নারিকেল পিঠা, নারিকেলের ভাজাপুলি, নারিকেলের সিদ্ধপুলি, নারিকেল জিলাপিবিবিখানা, চুটকি, চাপড়ি, ক্ষির কুলি, গোকুল, গোলাপ ফুলপিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল, জামদানি, ঝালপোয়া, ঝুরিপিঠা, ঝিনুক, সূর্যমুখী, নকশি, চাঁদ পাকান, ছিট, সুন্দরীপাকান, সরভাজা, পুলিপিঠা, পাটিসাপটা, পানতোয়া, মালপোয়া, মালাই, মুঠি, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলাপিঠা, খেজুরের পিঠা, তেজপাতাপিঠা, তেলেরপিঠা, তেলপোয়া, দুধরাজ, ফুলঝুরি, বিবিয়ানা, সেমাইপিঠা প্রভৃতি। সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছেÑ ভাপাপিঠা এবং চিতইপিঠা। কালের গভীরে কিছু পিঠা হারিয়ে গেলেও এখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। শীতকালে শুধু গ্রাম-বাংলায়ই নয়, শহর এলাকায়ও এখন পিঠা পাওয়া যায়। শীতের দাপট কিছু রুক্ষতার কথা বাদ দিলে শীত সবার কাছেই প্রিয় ঋতু।

এই ঋতুতে আমরা নিজেদের সাজাই অন্যরূপে। গোলাপ, বেলী, গাদা, চন্দ্রমল্লিকা, বকুল, চামিলীর সৌরভ সৌন্দর্য ফুটে ওঠে শীতের ছোঁয়ায়। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ ভরে ওঠে সর্ষে ফুলের হলুদ আভায়। মনে হয়, সারা মাঠে বুঝি হলুদ গালিচা পাতা। হলুদ শাড়িতে রাতের কুয়াশা ভিজিয়ে দিচ্ছে যেন রমণীকে। ভোরের শিউলি ফুল যেন তাজা হয়ে রাজত্ব করছে পুরো সময়কে। হলুদ, লাল আর কমলা রঙের শাড়িতে নিজেদের হেমন্তের সাজে সজ্জিত করেছে। হাতের মুঠোফোনে সেলফি আর ক্যাপশনের মধুরতার নৃত্যে মেতে উঠেছে ফেসবুক, টুইটার আর ইনস্টাগ্রাম। এক সময় পাতা ঝরা পাতার গাছ নতুন উদ্যমে জেগে ওঠে জানায় নতুন প্রাণের সঞ্জীবন। শীত পেরিয়ে উপস্থিত হয় ঋতুরাজ বসন্ত।

লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা, সংস্কৃতিকর্মী

 

×