ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

ভোট বাড়ানোর কৌশল ‘তৃণমূল লীগ’ নাকি ‘স্বতন্ত্র লীগ’!

​​​​​​​প্রণব সাহা

প্রকাশিত: ২১:১৩, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

ভোট বাড়ানোর কৌশল  ‘তৃণমূল লীগ’ নাকি ‘স্বতন্ত্র লীগ’!

.

তৃণমূল লীগশব্দটা উচ্চারিত হতেই ছ্যাঁৎ করে উঠলেন আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘তৃণমূল বিএনপি হলেই কি পাল্টা শব্দ তৃণমূল লীগ কথাটা সামনে আনতে হবে? আমরা জমজমাট ভোট চাই, তাই প্রার্থিতা উন্মুক্ত করা হয়েছে।চায়ের আড্ডায় বিতর্ক জমে উঠল আওয়ামী লীগের নতুন কৌশল নিয়ে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে কখনোই আওয়ামী লীগের এত বেশি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেননি।

আড্ডায় উপস্থিত সাংবাদিক বন্ধু ফোড়ন কাটলেন, ‘আরে ভাই কখনো তো একনাগাড়ে এতদিন ক্ষমতায় থাকেনি আওয়ামী লীগ।মাঠের বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে যোগ না দিলেও নির্বাচনে প্রার্থী কম নেই। বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ২০১৪ সালের শিক্ষায় আওয়ামী লীগের এটি নতুন কৌশল। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আরেকটিবিনা ভোটের নির্বাচনের কলঙ্ক’-এর পুনরাবৃত্তি ঘটানোর বিএনপির কৌশল মাঠে মারা গেছে বলে দাবি সেই আওয়ামী লীগ নেতার।

বিদায়ী একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ ২৮ জানুয়ারি শেষ হবে। দেশজুড়ে এখন পরবর্তী দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলছে। যে সংসদের মেয়াদ শেষের দিকে, তাতে আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২২টি আসনে জয়ী হয়েছিল। পরে একটি উপনির্বাচনে আরেক আসন বেড়েছিল। আগামী সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকুক, সেটিই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু মাঠের বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় আপাতত জাতীয় পার্টিই আবার বিরোধী দলের আসনে বসবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কিন্তু প্রশ্ন, যদি একক দল জাতীয় পার্টি থেকে বেশি সংখ্যক আসন পেয়ে যায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তা হলে কি সংসদে বিরোধী দল হবেস্বতন্ত্র লীগনাকিতৃণমূল লীগ’?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সবুজ সঙ্কেতেই এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর ছড়াছড়ি। আর বিগত পাঁচটি নির্বাচনের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বর্তমান আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য দলের মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায়, তাদের মধ্যেই অনেকেই নির্বাচনে লড়তে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এবারই রেকর্ড সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী ৭৪৭ জন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এর আগে অনুষ্ঠিত ১১টি নির্বাচনে কখনোই এই সংখ্যা ৫০০ জনের কোঠায়ও পৌঁছেনি। এর আগের ১১টি নির্বাচনে সব থেকে বেশি সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ২০০১ সালে ৪৮৬ জন। অবশ্য জয়ী হয়েছিলেন মাত্র জন। স্বতন্ত্র প্রাথী সবচেয়ে বেশি জয়ী হয়েছিলেন ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জাসদ (রব)-এর নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) সহ ৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিযেছিল। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ২১৪ জন। জয়ী হয়েছিলেন ২৫ জন।

বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টি মিলে কখনো মহাজোট আবার কখনো আসনভিত্তিক সমঝোতা হয়েছে। ২০০৮ ২০১৮ সালে ভোটের মাঠে জোট বেঁধে বিএনপি ঠেকানোর কৌশলে সফল হয়েছিল আওয়ামী লীগ। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে সফল হয়েছে।

এমনকি আওয়ামী সভাপতি শেখ হাসিনা বিএনপিকে গণভবনের সংলাপে আনতেও সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও সেই সংলাপে জোটবদ্ধভাবে বিরোধীদের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা শ্রদ্ধেয় . কামাল হোসেন। এবারের নির্বাচনের আগেই তিনি রাজনীতি থেকে বিশ্রাম নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপি এবার প্রথম থেকেই দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফার দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা করেছে গত ২৮ অক্টোবর। আজকের আলোচনা সেই আন্দোলন নিয়ে নয়। বরং দেখা যাক বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের কৌশল কতটা কাজে লাগে ভোটার আকর্ষণে?

সবশেষ ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন আর ২০১৪ বাদ দিয়ে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এবার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মতবিনিময়ে নতুন টার্মকার্ড ছাড়লেন, স্বতন্ত্র নির্বাচনে দলীয় নেতাদের সবুজ সঙ্কেত দিয়ে। এবার তাই রেকর্ড ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিলেন নির্বাচন কমিশনে। যাচাই-বাছাইয়ে অবশ্য প্রায় অর্ধেক স্বতন্ত্র প্রার্থী বাদ পড়েছেন। এখন চলছে আপিলের শুনানি। বলাবাহুল্য, মনোনয়ন বাতিলের মধ্যে আছেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা, যারা স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। আপিল শেষ হলে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় আরও স্পষ্ট হবে আওয়ামী লীগের কত নেতা আছেন সেখানে দলীয় প্রতীকের বাইরের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।

বিদ্যমান সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৩ সদস্য আছেন। আগামী জানুয়ারির ভোটে একক হিসেবে কোনো রাজনৈতিক দলের চেয়ে যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশি জয়ী হয়ে যান, তা হলে বিরোধী দল হিসেবে কি স্বতন্ত্র থেকেই কেউ হবেন বিরোধীদলীয় নেতা? স্বতন্ত্ররা কি নিজের দলে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগে যোগ দেবেন! নাকি তারাই একটি দল গঠন করে ফেলতে পারবেন? আইনগত বিষয়টি অন্য সময় আলোচনা করতে চাই। কারণ, যে আড্ডার কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, সেখানে যদি ফিরে যাই তাহলে বিতর্কটা এমন যে, একটি স্বতন্ত্র লীগ বা তৃণমূল লীগ হতেই পারে নির্বাচনের পরে। এটি একটি হাইপথিটিক্যাল কথা। কারণ, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরে নিয়েকিংস পার্টিহিসেবে তৃণমূল বিএনপি বা বিএনম নিয়ে যে শোরগোল উঠেছিল, চাওয়ার সঙ্গে পাওয়া না মেলায় শেষ পর্যন্ত জমল না বিষয়টি। এই মতও সেই আড্ডার। তাই কথা হচ্ছিল, তবে কি এবারস্বতন্ত্র লীগআরতৃণমূল লীগইভোটের নতুন ফেনোমেনা?

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

×