
.
ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্যাপ্তি প্রায় ৩২ বছর। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। সুদীর্ঘ ২৪ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাংলার জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতা। এই মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিনি ২৩ বছর ধরে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। এরই ধারবাহিকতায় নয় মাসের রক্তস্নাত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বিজয়ের এই মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার জগৎ কতটা প্রসারিত ছিল, তার ওপর আলোকপাত করার জন্যই এ নিবন্ধের অবতারণা। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। দেশের উন্নয়নের পথযাত্রায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে এমন বিষয়গুলো তাঁকে দারুণভাবে ভাবাত। এর মধ্যে অন্যতম ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা। প্রকৃতির ভয়াবহ রূপ ও নদী মরে যাওয়া নিয়ে তাঁর উদ্বেগের অন্ত ছিল না।
জলবায়ু পরিবর্তন, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন সবই ঘটছে প্রকৃতির ওপরে মানুষের অত্যাচারের কারণে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হয়েও জলবায়ু পরিবর্তনে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ১০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম (গ্লোবাল ক্লাইমেট রিক্স ইনডেক্স ২০২১ প্রতিবেদন)। ভাটি অঞ্চলের দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। তবে পাঁচ দশক আগে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আজকের মতো এতটা শোরগোল ছিল না। কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে তখনই ভেবেছেন ভবিষ্যৎদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু। সাইক্লোনের পূর্বাভাস পেলে তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ১৯৭০ সালের সাইক্লোনের ভয়াবহতা বঙ্গবন্ধু স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। নির্বাচনী প্রচার স্থগিত করে ছুটে গিয়েছিলেন ভোলার মনপুরায়। সাইক্লোনে ৫ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৭৩ সালের নভেম্বরের প্রথম দিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিন্মচাপটি সাইক্লোনে রূপ নেবেÑ বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ এমন পূর্বাভাস দিলে বঙ্গবন্ধু ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। শুরু হয় লোকজন সরানোর কাজ।
আনবিক শক্তি কমিশনের অধীন স্পেস অ্যান্ড এটমোস্ফেরিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক বিজ্ঞানী ড. এ এম চৌধুরী ছবির বিশ্লেষণ করেন। তিনি উপগ্রহ থেকে প্রেরিত ছবিতে দেখতে পান যে, সাইক্লোনটি গতি পরিবর্তন করে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি এবং আনবিক শক্তি কমিশনের তৎকালীন সদস্য ড. আনোয়ার হোসেন ছুটে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। ড. আনোয়ার হোসেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জানান যে, সাইক্লোন বাংলাদেশের দিকে আসবে না। গতিপথ পরিবর্তন করে ওড়িশার দিকে চলে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন যে, তিনি সারারাত আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছেন যেন সাইক্লোনটা আমাদের দিকে না আসে। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা শুনেছেন (‘বাংলাদেশ, আমি ও উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ’Ñ ড. এ এম চৌধুরী, প্রকাশক: একাডেমি প্রেস এন্ড পাবলিসার্স লাইব্রেরি)। এদিন ড. আনোয়ার হোসেন বঙ্গবন্ধুকে দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ও ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার পূর্বাভাস জানার জন্য ‘বাংলাদেশ আর্থ রিসোর্সেস টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ইআরটিএস) প্রোগ্রাম’ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফাইল পাঠাতে বললেন। প্ল্যানিং কমিশন থেকে ফাইলটি বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রেরণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাতে শুধু অনুমোদনই দেননি, দ্রুত বাস্তবায়নেরও নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ ইআরটিএস প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের ধারবাহিকতায় বাংলাদেশ ল্যান্ডস্যাট প্রোগ্রাম (বিএলপি) প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশে একটি ব-দ্বীপ, যেখানে ৭শ’রও বেশি নদী। বিস্তীর্ণ নিচু জমি ও জলাভূমি রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নিন্মাঞ্চলের গ্রামগুলো তলিয়ে যাওয়া এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে নদীগুলো মরে যাওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু চিন্তিত ছিলেন। নদী রক্ষা করা না গেলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নদ-নদী, সাগরের পানি ও সমুদ্র সম্পদের কী ক্ষতি হতে পারে, তা উপলব্ধি করেই বঙ্গবন্ধু নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। নিন্মাঞ্চলের গ্রামগুলোর তলিয়ে যাওয়া, ডেল্টা এলাকার উন্নয়ন এবং নদী বাঁচাতে প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের মাথা ঘামাতে বলেন। ১৯৭৫ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী ও কর্র্মকর্তাদের এক যৌথ সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যে কোনো দেশের শতকরা ৮০ ভাগ উন্নতি নির্ভর করে সে দেশের প্রকৌশলী ও কারিগরদের ওপর।’ স্থানীয় অবস্থার পটভূমিকায় সমস্যার সমাধান খোঁজার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের তিনি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার নদীগুলো মরে যাচ্ছে। . . . অনেক সময় দেখি, বিদেশী ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে বসে আপনারা অনেক প্ল্যান করেন। শুধু এমবাঙ্কমেন্ট করলে হবে না। . . . হল্যান্ডের মতো আমাদের গ্রামগুলো তো নিচে চলে যাবে। সেজন্য আপনারা বাংলাদেশ নিয়ে মাথা ঘামান।’
আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু নদী খননের কাজ শুরু করেন। এজন্য ক্রয় করা হয় নতুন ড্রেজারÑ ডেল্টা-১, ডেল্টা-২, ড্রেজার ১৩৫, ড্রেজার-১৩৬, ড্রেজার-১৩৭, ড্রেজার-১৩৮, ড্রেজার-১৩৯। ড্রেজারগুলো এখন অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সম্পদ। ডেল্টা-১ ও ২ নামের ড্রেজারগুলো ডেল্টা এলাকা তথা নদী ও গ্রাম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
এমনি একজন দূরদর্শী নেতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১ বছর বাংলাদেশে নদী বাঁচানো ও ডেল্টা এলাকার উন্নয়ন নিয়ে কোনো সরকার ভাবেনি। তবে আশার কথা, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান তথা ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ ঘোষণা করে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদের কিছু উদ্যোগের বাস্তবায়নও শুরু করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতোই নদী বাঁচানো নিয়ে শেখ হাসিনার মধ্যেও রয়েছে উদ্বেগ। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে, আমাদের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। আমাদের বাংলাদেশের বেঁচে থাকাও এই নদীর ওপর নির্ভর করে’ (বাসস, ৪ ডিসেম্বর ২০২৩)। তিনি শিল্প-সমৃদ্ধ দেশ কর্তৃক কার্বন নিঃসরণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামেও সোচ্চার। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় নেতৃত্ব এবং সোচ্চার কণ্ঠস্বরের স্বীকৃতি হিসেবে সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এবং জাতিসংঘ সমর্থিত গ্লোবাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট মোবিলিটি সংস্থা শেখ হাসিনাকে এশিয়া ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক