ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

রক্তাক্ত মাতৃভাষা-১১

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২১:০২, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

রক্তাক্ত মাতৃভাষা-১১

.

সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় এটি স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, ’৪৯ থেকে৫২ সাল পর্যন্ত সময়টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দী থাকায় গণতান্ত্রিক বা স্বাভাবিক রাজনীতি করার কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি যদি মুক্ত থাকতেন তবে আওয়ামী লীগের সম্প্রসারণই নয় পুরো পূর্ব বাংলার রাজনীতি ভিন্ন মাত্রা পেত। তবুও সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির একটি বিকল্প ধারা গড়ে  তোলেন।

অন্যদিকে জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। সোহরাওয়ার্দী এই অবস্থানে দৃঢ় থাকলে ভাষা আন্দোলন অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর এই মত পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তার সমর্থন আদায় করেন।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা সফরকালে পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গে প্রতিরোধের ঝড় ওঠে। বন্দী অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছাত্রনেতাদের আলোচনা হয় পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগÑ সকলেই এর তীব্র প্রতিবাদ করে। বঙ্গবন্ধু তখন হাসপাতালে ছিলেন। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা অলি আহাদ তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বঙ্গবন্ধু ওদের রাত একটার পরে আসতে বলেন। আরও বলেন, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুবসহ আরও কয়েক ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে। কারণ জানে বঙ্গবন্ধু পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়। বারান্দায় বসে নেতাদের সঙ্গে  আলাপ করেন এবং বলেন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে।

আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দেন। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেননি, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের সদস্য হননি তবুও বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতেন ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে  দেবে। কারণ, আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এসো। আরও দুএকজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বলেন। শওকত মিয়া কয়েক আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বলেন। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই এলো। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১  ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। ২৬ জানুয়ারি মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন উপলক্ষে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন বক্তৃতা করেন। উক্ত জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো তিনিও ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তার ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৮ সালের চাইতেও ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণায় জেলের অভ্যন্তরে তরুণ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ তখন ঢাকা জেলে বন্দী ছিলেন।

মহিউদ্দিন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধু ঠিক করলেনবঙ্গবন্ধু অসুস্থতার ভান করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হবেন এবং তারা বঙ্গবন্ধুকে ভর্তি করাতে সক্ষম হলেন। ভাষা আন্দোলনকে তীব্র গতিশীল করার উদ্দেশ্যেই এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন তারা। খুব সঙ্গত কারণেই পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনে তার প্রতিফলন লক্ষণীয়। ঢাকা জেলে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২বন্দি অবস্থা থেকে শামসুল হক চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ . গোলাম মাওলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ডেকে অ্যাসেম্বলি ঘেরাও  কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দান করেন। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার পর এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রায় হাজার ছাত্রছাত্রীর এক সুদীর্ঘ মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সারাশহর প্রদক্ষিণ করে। সভায় জননেতা মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম অন্যান্য রাজনৈতিক ছাত্রনেতারা তৎকালীন সরকারের জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সেদিনই ২১ ফেব্রুয়ারি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দেওয়া হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ধর্মঘটের ঘোষণায় মুসলিম লীগ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন বাড়িয়ে দেয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী আহূত ধর্মঘট সফল করার জন্য তখন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরকে যার যার অবস্থান থেকে কর্মসূচি প্রণয়ন গ্রহণ করতে হয়েছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেখ মুজিবুর রহমানের চিকিৎসা না করে ঢাকা জেলে প্রেরণ করা হয়।রাষ্ট্রভাষা বাংলাবন্দি মুক্তি দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ কারাগারের অভ্যন্তরে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। চারদিকে বিষয়টি জানাজানি হতে থাকে। বাইরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮ফেব্রুয়ারি তাদেরকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমদ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বরাবরে তাদের আটকাদেশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার না করা হলে ১৬ তারিখ থেকে অনশন ধর্মঘট করার হুমকি দিয়ে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। জেল কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন যাতে  অনশন ধর্মঘট না করেন। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনাবিচারে বন্দি রেখেছেন। কোনো অন্যায়ও করিনি। ঠিক করেছি, জেলের বাইরে যাব আমি- হয় জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব। তারা সরকারকে জানিয়ে দিলেন। বাইরে সমস্ত জেলায় ছাত্রলীগ কর্মীরা যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল সেখানে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল।

এদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া জেলের ভেতর বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমদ  প্রস্তুত হচ্ছিলেন অনশন ধর্মঘট করার জন্য। তারা আলোচনা করে ঠিক করলেন, যাই হোক না কেন, অনশন ভাঙবেন না। যদি পথেই মৃত্যু এসে থাকে তবে তাই হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালবেলা বঙ্গবন্ধুকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলো এই কথা বলে যে, তার সঙ্গে আলোচনা আছে অনশন ধর্মঘটের ব্যাপার নিয়ে। বঙ্গবন্ধু যখন জেলগেটে পৌঁছালেন দেখেন, একটু পরেই মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। এরই প্রেক্ষিতে সরকার তাদেরকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে প্রেরণের সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করে। নারায়ণগঞ্জ স্টিমারঘাটে তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল শামসুদ্দোহাসহ কয়েক ছাত্রনেতার। আলাপ-আলোচনা করলেন তারা। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললেন বঙ্গবন্ধু। এবং বললেন, আগামীকাল থেকে তারা আমরণ অনশন শুরু করবেন। ছাত্র নেতারা জানালেন২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব।রাত চারটায় ফরিদপুর পৌঁছালেন তারা। অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন তারা। দুদিন পর অবস্থা খারাপ হলে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। দুজনেরই শরীর খারাপ। একজন কয়েদিকে দিয়ে গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনিয়ে ভাসানী সাহেবের কাছে চিঠি লিখলেন বঙ্গবন্ধু

১০ ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড সফটওয়্যার-এর জনক

[email protected]
www.bijoyekushe.net
www.bijoydigital.com

আনন্দপত্র.বাংলা

×