ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইমাম জালালুদ্দিন মহল্লী ও ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি (র.)

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩

ইমাম জালালুদ্দিন মহল্লী ও ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি (র.)

প্রসঙ্গ ইসলাম

মুসলিম জাহানে এক বিশ্বয়কর কুরআনের তাফসির হলো জালালাইন শরীফ। আমাদের দেশে অনেক গ্রন্থাগারে এটি পাওয়া যায়। বিশেষ করে মাদ্রাসা ও বিশ^বিদ্যালয়ে কুরআনের তাফসির বিষয়ক ক্লাসে এটি একটি অনিবার্য শিক্ষাপ্রদ কিতাব। মজার বিষয় হলো, যেখানে কোনো গ্রন্থের লেখক থাকে একজন আর সেখানে এই গ্রন্থের লেখক দুজন। তাও আবার কাছাকাছি একই নামের। চলুন তা হলে সে বিশ^য়কর পবিত্র তাফসির গ্রন্থ ও এর দুই মহান রচয়িতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিই। আরবি ভাষায় জালাল শব্দের দ্বিবচন হলো জালালাইন। যেহেতু এটি দুই জালালের লেখা, তাই দুই নামের সম্পৃক্ততার কারণে তাফসির আল জালালাইন নামে অভিহিত করা হয়।

এর একজন লেখক তাফসিরশাস্ত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আল্লামা জালালুদ্দীন মহল্লী (র.)। যার প্রকৃত নাম মুহাম্মদ, উপাধি জালালুদ্দীন, পিতার নাম আহমদ। মহল্লী মিসরের কায়রোর নিকটবর্তী একটি শহরের নাম যা মহল্লায়ে কুবরা নামে প্রসিদ্ধ। এ শহরের অধিবাসী হওয়ায় তাকে জালালুদ্দীন মহল্লী বলা হয়। ৭৯১ হিজরি সনের শাওয়াল মাসে তার জন্ম। তিনি সর্বপ্রথম কুরআন মাজীদ হিফয করেন। অতঃপর কিছু ইবতেদায়ি কিতাবাদি অধ্যয়ন করেন। এরপর আল্লামা  জালাল বালকিনী, আলী ইরাকী ও শামস বারমারী (র.) প্রমুখের নিকট হতে ইলমে ফিকহের শিক্ষালাভ করেন। আল্লামা ইবনে জামায়ার নিকট ইলমে উসূল, আল্লামা শিহাব আযামী ও শামস শাতউনীর নিকট নাহুশাস্ত্র শিক্ষালাভ করেন। 
এরপর আল্লামা নাসিরুদ্দীন ইবনে আনাস মিসরী হানাফীর নিকট ইলমে ফারায়েয ও অঙ্কশাস্ত্র শেখেন। আল্লামা বদর মাহমুদের নিকট মানতিকশাস্ত্র, মায়ানী, বয়ান শাস্ত্র শিক্ষালাভ করেন। অবশেষে আল্লামা শামস ইবনে দায়রী হানাফী, মাজদ বারমাবী শাফেয়ী এবং শিহাব আহমদ মালেকী প্রমুখ আলিমের নিকট উসূলে দ্বীন ও তাফসিরশাস্ত্র শিক্ষালাভ করেন। আল্লামা আলী ইরাকী (র.) ইলমে হাদিসে তার ওস্তাদ ছিলেন। 
আল্লামা জালালুদ্দিন প্রথমে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। কিছু দিন পর নিজ ব্যবসায় অন্য একজন লোক নিযুক্ত করে তিনি ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের দারস তাদরিসের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। অসংখ্য ছাত্র তার নিকট ইলম হাসিল করেছে। সে দেশের সেই সময়ের বাদশাহ তাকে কাজির পদে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। কারণ, তিনি জ্ঞানচর্চা এবং জ্ঞান প্রচারের পেশা বেছে নিয়েছিলেন। ফলে, অন্য কোনো কর্মে তিনি আত্মনিয়োগ করেননি। আর প্রায় সময় ইতিহাসে দেখা গেছে সুবিধাবাদী মুসলিম শাসকগণ বড় বড় আলেমদের বিচারকের পদে বসিয়ে একতরফা ফতোয়া আদায় করতে চাইতেন। যা ইসলামের শরিয়তের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হতো।

যুগে যুগে বুজর্গ আলেমগণ ওই সব পদমর্যাদা আল্লাহর ওয়াস্তে প্রত্যাখ্যান করতেন। যেমন ইমাম আহমদ, ইমাম আবু হানিফা (র.) প্রমুখ। তিনি ব্যক্তি জীবনে ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার তথা আল্লাহভীরু। মাযহাবের দিক থেকে তিনি ছিলেন শাফেয়ী মতের অনুসারী। আল্লামা জালালুদ্দীন মহল্লী (র.) বহু শরাহ তথা ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন। তার বড় অবদান তাফসিরে জালালাইন শরীফ।  
পবিত্র কুরআনের শেষ ১৫ পারা তাফসির লেখার পর বাকি ১৫ পারা তাফসির লেখার ইচ্ছা পোষণ করে সূরা ফাতেহার তাফসির লিখতে শুরু করেছিলেন মাত্র। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারেননি।  ততদিনে তার মৃত্যু ঘণ্টা বেজে ওঠে। এ মহান মনীষী ৮৫৪ /৮৬৪ হিজরি সনের ১৫ রমজান শনিবার পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমান। পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে তার সুযোগ্য ছাত্র আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (র.) তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন। 
একইভাবে কিতাবটির অপর লেখক আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতিও (র.) ইতিহাসের এক বিস্ময়কর প্রতিভা ছিলেন। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখায় তিনি অবদান রেখে গেছেন। যার সুবিশাল রচনাসম্ভার আজও মানুষের কাছে এক মহাবিস্ময়। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (র.) ৮৪৯ হিজরির রজব মাসে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম আবদুর রহমান ইবনে কামালুদ্দিন আবু বকর (র.)। পিতা তার উপাধি নির্ধারণ করেন জালালুদ্দিন। তার পিতাও ছিলেন একজন খ্যাতিমান আলিম, খলিফার রাজপ্রাসাদের ইমাম এবং গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজে রাজ দরবারের প্রতিনিধি। বলা হয়ে থাকে, পিতার কুতুবখানায় (পাঠাগার) জন্ম হওয়ায় তাকে ‘ইবনুল কুতুব’ বলা হয়।

ইমাম সুয়ুতি (র.) ছিলেন ঐতিহ্যবাহী আলিম পরিবারের উত্তরাধিকার। তার দাদার উপাধি ছিল ‘হুমামুদ্দিন’ (দ্বিনের ব্যাপারে দৃঢ়চিত্ত)। কেননা, তিনি ছিলেন একজন গবেষক, আলিম ও আধ্যাত্মিক সাধক। তার পিতাও ফিকহ-ইসলামী আইন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে পারদর্শী। ফলে, তিনি পারিবারিকভাবেই জ্ঞানচর্চার পরিবেশ লাভ করেন। আল্লামা সুয়ুতির (র.) পিতা ছিলেন হাফেজ ইবনে হাজার আস্কালানির (র.) শিষ্য। 
ধারণা করা হয়, পিতা আল্লামা সুয়ুতিকে আল্লামা আস্কালানির মজলিসে নিয়ে যেতেন এবং তার দোয়া ও সুদৃষ্টি কামনা করতেন। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (র.) ছয় বছর বয়সে পিতাকে হারান। আট বছর বয়সে তিনি কুরআন হিফজ করেন। শৈশবে পবিত্র কুরআন ছাড়াও আরও কিছু কিতাব তিনি মুখস্থ করেন। যার মধ্যে উমদাতুল আহকাম, আল-মিনহাজুল ফারয়ি, আল-মিনহাজ ফিল উসুল, মিনহাজুল বায়দাবি ইত্যাদি। ইমাম সুয়ুতি (র.) সময়ের বহু খ্যাতিমান আলিমদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন। তাদের মধ্যে শায়খ শরফুদ্দিন মুনাভি ও  মুহিউদ্দিনের (র.) দীর্ঘ সান্নিধ্য লাভ করেন।
বয়স তার ১৫ বছর হওয়ার আগেই জ্ঞানার্জনের জন্য নানা অঞ্চলে সফরে বের হয়ে যান তিনি। এ ছাড়া জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি পূর্ণ এক বছর মাক্কায় অবস্থান করেন এবং মদিনা, শাম, মরক্কো ও গিনিতে সফর করেন। তিনি এসব অঞ্চলের প্রধান আলিমদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘আউজুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ’ বিষয়ে বই লিখে সমকালীন আলিমদের প্রশংসা কুড়ান। এই বয়সেই তিনি শিক্ষকতা ও ফতোয়া প্রদান আরম্ভ করেন। ৮৭১ হিজরিতে তিনি কায়রোর জামিয়া শায়খুনিয়ার শায়খুল হাদিস পদ অলঙ্কৃত করেন।

কিন্তু জীবনের এক পর্যায়ে ইমাম সুয়ুতি (র.) নিভৃতচারী হয়ে যান এবং লেখালেখিতে পূর্ণ মনোযোগ দেন। ইমাম সুয়ুতির (র.) ছোট-বড় রচনার পরিমাণ পাঁচ শতাধিক। তার বড় অবদান বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ‘জালালাইন’-এর প্রথম ১৫ পারার তাফসির কাজ সুসমাপ্তিকরণ। যেভাবে এবং যে মন মেজাজে তার মরহুম ওস্তাদ এ গ্রন্থের সমাপনী ১৫ পারার কাজ সম্পন্ন করে বিশাল এক কর্মযজ্ঞের শুভ সূচনা করে গিয়েছিলেন। 
 ইমাম সুয়ুতির (র.) রচনাবলির মধ্যে শরহু ইবনে মাজাহ, আত-তিব্বুন নববী, আল-আশবাহ ওয়ান-নাজায়ের, আল-হাবি লিল-ফাতাওয়া, তারিখুল খুলাফা, আল-জামিউল কাবির, তাবাকাতুল হুফফাজ, লুবাবুল হাদিস বিখ্যাত। বিশ্ববিখ্যাত এ আলিম ১৯ জমা. আউয়াল মোতাবেক ৩০ সেপ্টেম্বর ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে মিসরে ইন্তেকাল করেন। উল্লেখ্য, জালালাইন শরীফ তাফসিরের একটি সংক্ষিপ্ত কিতাব, যাকে পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা না বলে আরবী তরজমা বললেও চলে। এতে শুধু কুরআনুল কারিমের কঠিন কঠিন শব্দগুলোকে সহজ সরল শব্দ দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বস্তুত এ গ্রন্থের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো অতি সংক্ষেপ আলোচনা।

এমনকি কুরআনের ব্যাখ্যা বা তাফসির হলেও শব্দ এবং বাক্য কুরআনের মূল বাক্যেরই সমান। এ জন্য গবেষক ও মোদ্দা পাঠক ছাড়া সাধারণ পাঠকের জন্য এটি একটি বহুল আলোচিত কঠিন তাফসির গ্রন্থ। কিন্তু স্কলারদের কাছে এটি প্রিয় হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ এটি অতি সংক্ষিপ্ত এবং অখ-। এ কিতাবে মাঝে মধ্যে আয়াতের অর্থকে সুস্পষ্ট করে বোঝানোর জন্য আয়াতের শেষে ছোট ছোট বাক্য সংযোজন করা হয়েছে। আবার কখনো কখনো প্রয়োজনীয় কোনো ঘটনাকে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাফসিরে জালালাইন সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় গ্রহণীয় কিতাব। আসুন আমরা এ মহান দুই মুফাসসিরদের স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখি, তাদের জন্য দোয়া করি এবং পবিত্র জালালাইন শরীফটি ঘরে রাখি, বরকত ও শিক্ষার জন্য অধ্যয়ন করি। 

লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]

×