
উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারায় দেশ
এক জটিল সময়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম (প্রথম নাম পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ)। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হলেও মূলত এই দলটি গড়ে উঠেছে শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মত্যাগ, সততা, দেশপ্রেম ও সৃজনশীলতার অভাবনীয় সমন্বয়ের কারণে। দেশ বিভাগের পরে মুসলিম লীগের প্রতি অনাস্থায় সমবায়ী কণ্ঠস্বর আওয়ামী লীগ। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগের গণতন্ত্রহীনতা, জবরদস্তিতন্ত্রের কারণে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে যে ব্যাপক জন অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল, তারই ফসল আওয়ামী লীগ।
১৯৪৭ সালে শেখ মুজিবের সৃষ্টি ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মোচন করে। ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইল থেকে উপনির্বাচনে শামসুল হক মুসলিম লীগের প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। সেটিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের একটি অঞ্চলের মানুষের অনাস্থা- মুসলিম লীগের প্রতি অনাস্থা। আরও ভোটের বা ব্যালটের মাধ্যমে প্রকাশিত প্রথম অনাস্থা। সারা দেশেই এই অনাস্থা তৈরি হয়েছিল। আর তখনই মানুষের জন্য কাজ করার জন্য দলটির জন্ম হয়। সেই দলই বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ ২২৩টি মুসলিম আসনে জয়লাভ করে। তার মধ্যে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের’ আসন ছিল ১৪৩টি। এটা থেকেও বোঝা যায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা। এই ধারা অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন, তখন পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে তার যে প্রভাব দেখা গিয়েছিল, তারই ফল ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। আইয়ুব খানের পতন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আওয়ামী লীগ জড়িত- বিষয়টি এমন নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র্রটির জন্ম হয়েছিল আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই। জনগণকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করেন বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পরে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই এখন বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাক্সক্ষার জায়গা। অথচ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শেখ হাসিনা ৬ বছর দেশেই ফিরতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, জিয়াউর রহমান আইন করে তার বিচার পর্যন্ত করতে দেননি। ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত ২১ বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ চলেছে স্বৈরশাসনে। তৈরি হয়েছে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। সংবিধান পরিবর্তন করে এটাকে ‘পাকিস্তান’-টাইপ রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। উন্নয়ন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেভাবে হওয়ার কথাÑ হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাদের বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া সে সময় বাংলাদেশে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো।
শেখ হাসিনা দেশে আসার পরে যে গণআন্দোলন শুরু করেন, সেই আন্দোলন মূলত গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন। কারণ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে, সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটলে, সাধারণ মানুষ তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারলেই প্রতিষ্ঠিত হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। কিন্তু এ দেশে বারবার গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচন আমরা দেখেছি। নির্বাচনের পর ধর্মীয় উগ্রবাদ কীভাবে দানা বেঁধেছিল!
এ দেশের সাধারণ মানুষ এবং সংখ্যালঘুদের ওপর কিভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছিল- তাও জানি আমরা। আমরা দেখেছি, ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা। এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা, দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ, তরুণ সমাজ কোনোভাবেই তা মেনে নিতে পারেনি। এ জন্য পরবর্তী নির্বাচনে তারা বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলÑ যুদ্ধাপরাধের বিচারÑ তা তারা নিশ্চিত করেছে। এ দেশের কিছু মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাদের কয়েকদিন আগেও আমরা গাড়িতে জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরতে দেখেছি, তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে এবং আইনের মাধ্যমেই সেই বিচার করা হয়েছে।
১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশে যে উন্নয়নের সূচনা করেছিলেন, তা চার দলীয় সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী শুধু অবরুদ্ধই করেনি। তাদের কারণে আমরা ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকার দেখলাম। আমরা জাতির পিতার কন্যা ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে জেলে যেতে দেখলাম। বাংলাদেশের মানুষ এরপরই বুঝে গেছে উন্নয়ন যদি অব্যাহত রাখতে হয়, তবে বারবার শেখ হাসিনাকে এ দেশের ক্ষমতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনেকগুলো ফ্লাইওভার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, ঢাকা-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ, ঢাকা-বেনাপোল রেল যোগাযোগ, ঢাকা-খুলনা নতুন লাইনে রেল যোগাযোগ, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর-এসব মেগা প্রকল্প করা সম্ভব হয়েছে সরকারের ধারাবাহিকতার জন্য।
বাংলাদেশের মানুষ একসঙ্গে ১০০টি সেতু উদ্বোধন হতে দেখেছে। এমন অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে এবং উন্নয়ন চলমান। এর পেছনে অবশ্যই সরকারের ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কারণ, অনেক প্রকল্প এখনও চলমান। সরকার কোনো কারণে বদলে গেলে, সেগুলো স্থবির হয়ে যাবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে, তা বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ছিল সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি। এখন শুধু সৃজনশীলতা দিয়েই হচ্ছে না। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হতে হলে আরও বাস্তব ও প্রয়োগ উপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম আবশ্যক। সরকার নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে সেটিই বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর। নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে একজন শিক্ষার্থী বাস্তবিক প্রায়োগিক জ্ঞান লাভ করছে, যা তাদের ভবিষ্যতের জন্য খুবই দরকার। স্মার্ট নাগরিক সৃষ্টিতে এর কোনো বিকল্প নেই।
মোটকথা, শেখ হাসিনা সরকার এ দেশের মানুষের সরকার। তারা যা করেছে এ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য করেছে। এ দেশের মানুষও বারবার তাকে ও তার দলকে নির্বাচিত করার মাধ্যমে তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তাই আওয়ামী লীগ সতর্কভাবে প্রার্থী বাছাই করেছে। দল ও দেশের প্রয়োজনে বর্তমান আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে ৭২ জন সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। ৬৯ জন প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই তরুণ। আবার অনেক পুরনো ও ত্যাগী নেতাকর্মীও এবার মনোনয়ন পেয়েছেন। এ থেকেও বোঝা যায় যে, আওয়ামী লীগে ভুলের কোনো জায়গা নেই। আওয়ামী লীগ করে ভুল করা যাবে না।
কারণ, জনগণ সবসময় সবকিছু খেয়াল রাখে। আর আওয়ামী লীগ জনগণের দল। জনগণ বা বাংলাদেশের মানুষের আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা আছে। শেখ হাসিনার ত্যাগ ও আদর্শ তারা জানে। তরুণ প্রজন্ম বারবার তার ওপরই আস্থা রেখেছে। তারা জানে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগের বিকল্প বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়নি। তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মনোনিবেশ করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি);
পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)