ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হেনরি কিসিঞ্জারের বিদায়

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ২ ডিসেম্বর ২০২৩

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হেনরি কিসিঞ্জারের বিদায়

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

বাংলাদেশমুখী পিএল ৪৮০-এর গমবোঝাই জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে আর জাহাজ বোঝাই গম সাগরে খালাশ করে এ দেশে ’৭৪-এর প্রায় দুর্ভিক্ষের সফল মঞ্চায়ন করে তিনি তার সেই অমর উক্তির যৌক্তিকতারও প্রমাণ রেখেছিলেন। সপরিবারে প্রাণ হারিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দেশ তারপর থেকে পেছনে ছুটেছিল শত মিটার স্প্রিন্টের ঝড়ো গতিতে

সদ্য প্রয়াত হয়েছেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জার। কানেকটিকাটে নিজ বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে জানা গেছে। খবরটা শুনে আমাদের মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। ড. কিসিঞ্জারের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না, থাকার সুযোগও নেই। তিনি ছিলেন অনেক ওপর তলার বাসিন্দা। তারপরও তার সঙ্গে এক ধরনের পরিচয় ছিল। সেটি তার আত্মজীবনী হোয়াইট হাউস ইয়ারসের মাধ্যমে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে। দুই খ-ের বিশাল ওই বইটির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর অধ্যায়টি আমি অনুবাদ করেছিলাম।

সে সময় এটি ধারাবাহিকভাবে একটি জাতীয় সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয়। পরবর্র্তীতে একে মলাটবন্দি করার সুযোগও হয়েছিল। আমার প্রথম প্রকাশিত এই বইটির নাম ছিল ‘প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।’ বইটি যখন প্রকাশিত হয় আমি তখন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে চুতর্থ বর্ষের ছাত্র। সেটি ১৯৯৪ সালের কথা। কিসিঞ্জারের সঙ্গে সেই যে যোগাযোগ, তা অব্যাহত ছিল তার মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত। বাংলাদেশে যারাই একাত্তর নিয়ে ভাবেন কিংবা রাজনীতির অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করেন, বরং বলা যায় বাংলাদেশের যে কোনো সচেতন নাগরিকের সঙ্গেই বোধকরি হেনরি কিসিঞ্জারের এই নাড়ির যোগাযোগটি ছিল।

আর শুধু বাংলাদেশই বা বলি কেন, আমাদের তো ধারণা ’৬০ আর ’৭০-এর দশকে যারা পৃথিবীর দেশে দেশে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা পরবর্তী সময় এসব বিষয় চর্চা করেছেন, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই হেনরি কিসিঞ্জারের এ ধরনের একটা যোগাযোগ ছিল। কারণটাও খুবই সঙ্গত। সে সময়টায় পৃথিবীর দেশে দেশে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের যে নিধন এবং পতন, সে সবের  বেশির ভাগের পেছনেই প্রয়াত এই সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফুটপ্রিন্ট দেখতে পান দেশে দেশে রাজনীতির অনেক বোদ্ধা বিশ্লেষকই।
ড. কিসিঞ্জার যে একজন বড় মাপের কূটনীতিক ছিলেন সে বিষয়ে কারও সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকার সুযোগই নেই। আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে তার দুই ভলিউমের যে বিশাল আত্মজীবনী, সেটিই এর বড় প্রমাণ, তবে নিঃসন্দেহে একমাত্র প্রমাণ নয়। কিসিঞ্জারের জটিল কূটনীতি আর দূরদৃষ্টির সবচেয়ে বড় প্রমাণ বোধকরি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি। সেই যুগে, সেই কোনো আমলে তার প্রণীত যে পররাষ্ট্রনীতি, সেই জায়গাটা থেকে এখনো যুক্তরাষ্ট্র খুব সরে এসেছে বলে মনে হয় না। এর মাঝে কেটে গেছে একের পর এক দশক।

দ্বিকেন্দ্রিক পৃথিবী এককেন্দ্রিক হয়ে এখন বহু কেন্দ্রিক হওয়ার পথে। সময়ের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দফায় দফায় সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। পৃথিবীর দেশে দেশে পরিবর্তন হয়েছে মার্কিনিদের মিত্রও। কিন্তু বদলায়নি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি। সেদিনের কিউবা, চিলি কিংবা, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে মাঝের ইরাক, সিরিয়া কিংবা লিবিয়া, হালের আফগানিস্তান কিংবা ফিলিস্তিন যেদিকেই তাকান না কেন, এই বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পেতে বোধ করি খুব একটা বড় বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এমনটি যে মার্কিনীদের কাছে বিশে^র মানচিত্রটা আমেরিকায় শুরু হয়ে কানাডায় গিয়ে শেষ হয়, সেই উদাসীন মার্কিনিরাও সময়ে সময়ে রাস্তায় নেমেও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে কিসিঞ্জারের প্রভাবমুক্ত করতে পারেনি।
মাঝে মধ্যেই মনে হয় শেষ দিনগুলো কেমন কেটেছিল তথাকথিত চরম সফল মানুষটির? এত সাফল্যের ভিড়ে কোনো অপ্রাপ্তি কিংবা ব্যর্থতার গ্লানিটি কোনো এক অলস বিকেলে কখনো তার জন্য এতটুকুও মর্মপীড়ার কারণ কি হয়নি? আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে লেখাপড়া সামান্যই। একটু-আধটু আড্ডায়-চর্চায় যতটুকু জানা যায়, ততটুকুই। এর বেশি এতটুকুও নয়। তারপরও মনে হয় অন্তত একটা জায়গায় বোধকরি তার কিছুটা হলেও অপ্রাপ্তির বেদনাবোধ থেকে গেছে। হয়তো মনের কোনো এক গহিন কোনে এতটুকু বেদনা নিয়েই পৃথিবী ছেড়েছেন শতবর্ষী এই কূটনীতিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে মার্কিন সরকারের যে ভূমিকা, তা সর্বজনবিদিত।

তারপরও স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। সদ্য স্বাধীন সেই দেশটিকে ড. কিসিঞ্জার আখ্যায়িত করেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশমুখী পিএল ৪৮০-এর গমবোঝাই জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে আর জাহাজ বোঝাই গম সাগরে খালাশ করে এ দেশে ’৭৪-এর প্রায় দুর্ভিক্ষের সফল মঞ্চায়ন করে তিনি তার সেই অমর উক্তির যৌক্তিকতারও প্রমাণ রেখেছিলেন। সপরিবারে প্রাণ হারিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দেশ তারপর থেকে পেছনে ছুটেছিল শত মিটার স্প্রিন্টের ঝড়ো গতিতে। সব ঠিকঠাক মতোই চলছিল। কিন্তু কেন যেন শেষমেশ শেষ রক্ষাটা হলো না। কি এক জাদুর স্পর্শে ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের রোল মডেল হওয়ার পথে যে উল্লম্ফন- তা দেখে আর সেই বেদনাটুকু অন্তরে ধারণ করেই ঘটেছে এই মহাজ্ঞানীর মহাপ্রয়াণ!


লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও 
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

×