ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

রাজধানীর চারপাশে নদীদূষণ রোধে করণীয়

মো. নজমুল হক

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ২৮ নভেম্বর ২০২৩

রাজধানীর চারপাশে নদীদূষণ রোধে করণীয়

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অর্থাৎ নদী থেকে এ দেশের জন্ম। যুগে যুগে নদী অববাহিকায় গড়ে উঠেছে বিশ্বের বহু সভ্যতা। বহু নামকরা শহর গড়ে উঠেছে অনেক হাজার বছরের পুরনো বিখ্যাত নদীর তীরে যেমন- টেমস নদীর তীরে লন্ডন, হাডসনের তীরে নিউইয়র্ক, নীল নদের তীরে মিসর, গঙ্গার তীরে কলকাতা। তেমন আমাদের ঢাকাকে ঘিরে রয়েছে বুড়িগঙ্গাসহ তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী। এসব নদীর সুপেয় স্বচ্ছ পানি, কৃষি, সেচ, চলাচল ও মৎস্যের উৎস হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানুষের চাহিদা পূরণ করেছে। মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো সব উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে। দূষণে জর্জরিত নদীগুলোর বেহাল দশা।

ঢাকা শহর ও বাইরের শিল্প-কারখানার বর্জ্য বিশেষ করে ট্যানারি ও ডায়িং মিলের উচ্ছিষ্ট বর্জ্য, অপরিশোধিত পয়ঃপ্রণালির বর্জ্য, গৃহস্থালীর কঠিন ও তরল বর্জ্য, পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, হাসপাতাল বর্জ্য, নৌযানের ময়লা বর্জ্য ও তেল প্রতিনিয়ত নদীগুলোর পানির সঙ্গে মিশে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের নদীর পানি দূষিত করে চলেছে। এসব নদীর পানির রং এখন আলকাতরার মতো এবং উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব নদীতে বেশিরভাগ জায়গায় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ১ মিলিগ্রামের নিচে নেমে গেছে। যেখানে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা অন্তত ৫ মিলিগ্রাম না হলে তা জীবন ধারণের অনুপযোগী বলে বিবেচিত হয়। কয়েক বছর আগেও যে নদীগুলো ছিল মাছের আধার, এখন তা মৎস্যশূন্য হয়ে পড়েছে। এমনকি দূষিত পানিতে জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে পড়েছে।

 যে বুড়িগঙ্গা নদী ঢাকা শহরকে জন্ম দিয়েছে, সেটি আজ জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত। মারাত্মকভাবে দূষিত হওয়ার জন্য নদীগুলোর পানি ব্যবহারে সম্পূর্ণ অনুপযোগী। তাই সুপেয় পানির জন্য ঢাকার বাসিন্দারা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ও আশঙ্কাজনকভাবে নেমে গেছে। এর চূড়ান্ত পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
অতীতে ইংল্যান্ডের টেমস নদীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়েছিল। বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে এ নদীর পানিকে পরিপূর্ণভাবে দূষণমুক্ত করা সম্ভব হয়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, টেমস নদীর এই শোধন ক্রিয়ার উদাহরণ নিঃসন্দেহে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের চারটি নদীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করতে ধাপে ধাপে সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণের বিকল্প নেই।
এ ছাড়াও ভূমি দস্যুদের ক্ষমতার দাপটে নদীর ধারে বিভিন্ন স্থানে ভরাট করে শিল্প কল- কারখানা, ক্লাব ঘর, ধর্মীয় স্থাপনার নামে মসজিদ, মক্তব-মাদ্রাসা ইত্যাদি নির্মাণের ফলে নদীর পানির প্রবাহ কমে ছোট-বড় অনেক নদী সঙ্কীর্ণ হয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ছে। আশার কথা, সরকার জরুরি টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে নদীতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ শুরু করায় ভূমি দস্যুদের এ ধরনের তৎপরতা কিছুটা হলেও কমে এসেছে।
ঢাকার চারপাশের দূষণকবলিত নদী চারটির বেহালদশা থেকে উত্তরণে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারেÑ
১) প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন এবং বাস্তবে তা যেন চালু রাখা হয় তা নিশ্চিতকরণ।
২) অপরিশোধিত পয়ঃপ্রণালি, গৃহস্থালীর কঠিন বর্জ্য, মেডিক্যাল বর্জ্য যেন সরাসরি নদীতে নিক্ষিপ্ত না হয়, তা নিশ্চিতকরণ।
৩) নদী দখল ও নদী ভরাটের হাত থেকে নদীগুলোকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীসমূহে দ্রুত নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে।
৪) ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
৫) নদীগুলো রক্ষায় টাস্কফোর্স গঠন এবং সারাবছর এদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
৬) অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে নদী রক্ষায় আদালতের আদেশ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
৭) স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে নদ-নদীর বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমাদের জীবনে নদ-নদীর ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সকলের মধ্যে নদ-নদীর প্রতি সম্মানবোধ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : সরকারি কর্মকর্তা (অব.) 

×