ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি দক্ষ প্রজন্ম তৈরির হাতিয়ার

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২১:১৪, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি  দক্ষ প্রজন্ম তৈরির হাতিয়ার

.

সর্বক্ষেত্র এখন তথ্যপ্রযুক্তিময়। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তিত বিশ্বে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে প্রযুক্তি।  বদলাচ্ছে মানুষের যান্ত্রিক জীবনও। জীবনের এক মুহূর্তও প্রযুক্তি ছাড়া চিন্তাভাবনা করা যায় না। তাই প্রযুক্তিনির্ভর ক্যারিয়ারের দিকে ধাবিত হচ্ছে তরুণ সমাজ। গতানুগতিক শিক্ষার আশায় বসে না থেকে বাস্তবমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ত্বরান্বিত করা যায় প্রযুক্তির সহায়তায় সহজে স্বল্প সময়ে। প্রযুক্তিনির্ভর কর্মমুখী শিক্ষার চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের আগমনের ফলে এই পরিবর্তন আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে। এসবের ফলে কর্মক্ষেত্রে হয়তো লোকবলের চাহিদা কমে যাবে ঠিকই কিন্তু প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে চাই দক্ষ জনশক্তি। ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি এমনই এক উচ্চগতির প্রযুক্তি, যা অল্প সময়ে মানুষকে দ্রুত কর্মক্ষম করে তুলতে সহায়তা করে।

আমরা জানি, মানুষের বুদ্ধিমত্তা চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তিনির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজ। এটি এমন একটি বিশেষ প্রযুক্তিগত কৌশল, যার মাধ্যমে কম্পিউটারকে মিমিকস কগনেটিক এককে আনা হয়। ফলে কম্পিউটার মানুষের মতো ভাবতে কাজ করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) হলো মেশিন দ্বারা প্রদর্শিত বুদ্ধি বিশেষ। করোনা পরিস্থিতির কারণে একদিকে পৃথিবী যেমন প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে, অন্যদিকে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি ব্যবহারকে ত্বরান্বিত করছে। তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি বা উচ্চ গতির প্রযুক্তি বলতে একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভাবিত অগ্রসর প্রযুক্তিকে বোঝায়। ইংরেজি পরিভাষায় এগুলোকেহাই টেকবাহাই টেকনোলজিবলা হয়। অনেক সময় এগুলোকেফ্রন্টিয়ার টেকনামেও অভিহিত করা হয়। শব্দটি আমাদের কাছে নতুন মনে হলেও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরদ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসপত্রিকার একটি নিবন্ধে প্রথম ইংরেজি ভাষায়হাই টেকনোলজিশব্দটি ব্যবহার করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল পেটেন্ট ক্লাসিফিকেশন অনুযায়ী বিমান প্রযুক্তিযোগাযোগ প্রযুক্তি (টেলিযোগাযোগ বেতার যোগাযোগ), কম্পিউটার প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয় ব্যবসা সরঞ্জাম প্রযুক্তিলেজার প্রযুক্তিঅণুজীব প্রযুক্তি বংশাণু প্রকৌশলঅর্ধপরিবাহী প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলোকে  ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়াও অস্ত্র প্রযুক্তি, রাসায়নিক প্রযুক্তি (জীবাণুনাশক, তেজস্ক্রিয় পদার্থ), বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি, বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি, ঔষধনির্মাণ প্রযুক্তি, আলোকীয় প্রযুক্তি, রোবটীয় প্রযুক্তি মহাকাশযান নির্মাণ প্রযুক্তি উচ্চ প্রযুক্তি বা ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির আওতায় পড়ে।

আগামীতে এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে হলে বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন- ব্লকচেন, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংস, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, মহাকাশ বিজ্ঞান, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, ক্লাউড কম্পিউটিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটার, মেশিন লার্নিং, ন্যানো টেকনোলজি, ফার্মাসিউটিক্যাল (ঔষধ প্রযুক্তি), বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিগ ডাটা অ্যানালাইসিস, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, থ্রিডি প্রিন্টিং ইত্যাদি বিষয় হাতে-কলমে শেখার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করত, তা বাস্তবে প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি। সব প্রযুক্তিতে দেশের  লক্ষ লক্ষ  তরুণকে দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুরে ৭০ একর জায়গার ওপর ১৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছেশেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি সফটওয়্যার টেকনোলজি (শিফট)’ পার্ক। দেশের মধ্যে এটিই হবে প্রথম ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলা এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট প্রজন্ম তৈরি হবে এখান থেকেই।

ইনস্টিটিউটে থাকবে অত্যাধুনিক গবেষণাগার বিশেষায়িত ল্যাব। ল্যাবগুলোতে থাকবে ন্যানো টেকনোলজি থেকে শুরু করে মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই। এখানে গতানুগতিক শিক্ষার পাশাপাশি পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রযুক্তি জ্ঞানে দক্ষ হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীরা। সিঙ্গাপুরের স্কিলড ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান, আমেরিকার ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি), থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এআইটি), মালয়েশিয়া, চীন জাপানের মতো বড় ইনস্টিটিটিউটগুলোর সঙ্গে এই ইনস্টিটিটিউটের যৌথ গবেষণা করার সুযোগ থাকবে।

প্রতিষ্ঠানটি পরিপূর্ণতা পেলে বিশ্বসেরা প্রযুক্তিবিদ তৈরি হবে এখান থেকেই। যারা বাংলাদেশে বসেই আমাজন, গুগল, মাইক্রোসফট কিংবা অ্যাপলের মতো কাজ করতে সক্ষম হবে এবং নাসা, এরোস্পেসের মতো মহাকাশযান তৈরিতে অবদান রাখবে। তারা তৈরি করবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, ডেভেলপ করবে ভার্চুয়াল স্টোরেজ, ক্লাউড কম্পিউটিং আর্কিটেকচার, অ্যাটোমিক মেডিসিন, ন্যানোচিপ ইত্যাদি। শিক্ষার্থীরা গবেষণা করে প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শুধু বাংলাদেশের সমস্যাই সমাধান করবে না, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে বিশ্বব্যাপী। এই ইনস্টিটিউট থেকেই তৈরি হবে বিমান তৈরি করার মতো প্রযুক্তিবিদ, চাঁদে গমন করার বৈজ্ঞানিক, গবেষক, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের শিক্ষার্থীরাও এখানে আসবে হাতে কলমে কাজ শিখতে, গবেষণা করতে। সেজন্য দেশের প্রথিতযশা অধ্যাপক (Professor in Practice), উদ্যোক্তা (Entrepreneur in Practice), ব্যবসায়ী (Business in Practice), বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীয় ভিজিটিং প্রফেসর/উদ্যোক্তাদের এখানে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ডব্লিউইউএসএমই (The World Union of Small and Medium Enterprise) এর সঙ্গে শুরুতেই সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এতে প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতা গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।  থাকবে গতিশীল নিরাপদ।

উন্নত দেশগুলো মুখস্ত বিদ্যার পরিবর্তে হাতে-কলমে শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে।  ঢাকার মিরপুরে বাংলাদেশ-জার্মান কারিগরি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রতিষ্ঠান এবং কিছু কিছু পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে হাতে কলমে কাজ করার ব্যবস্থা থাকলেও অন্যগুলোতে নেই। ফ্রন্টিয়ার ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীরা তথাকথিত মুখস্ত বিদ্যার পরিবর্তে হাতে-কলমে শিখবে, দক্ষতা জ্ঞানভিত্তিক বিশ্ব তৈরিতে অবদান রাখবে। তাই আধুনিক পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এখনই ইন্ডাস্ট্রি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত  প্রচেষ্টায় আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মানবসম্পদ তৈরির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান বিশ্বের অন্যতম উদ্ভাবনীয় আইটি শিল্পসমৃদ্ধ দেশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিপুল সংখ্যক আইটি পেশাদার এখানে কাজ করে এবং প্রতিবছর আরও কয়েক লাখ দক্ষ পেশাদার জনবল প্রয়োজন হয়।

কিন্তু তাদের জনসংখ্যার সংকট রয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ভোগ করছে। এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে জাপানসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট অব থিংস, রোবটিক্স, ইমার্জিং ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কোর্স কারিকুলাম তৈরি করে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজিকে এগিয়ে নিতে হবে। আগামীদিনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হবে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি। জ্ঞান এবং প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়ার হাতিয়ারই হবে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি। আগামীতে ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তিতে দক্ষ মানুষরাই হবেন ডিজিটাল বিপ্লবের বিশ্ব নেতা।

লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×