
ভারতের সরকার সম্প্রতি দেশটির ইন্ডিয়া নামটি থেকে সরে এসেছে
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সরকার সম্প্রতি দেশটির ইন্ডিয়া নামটি থেকে সরে এসেছে। এখন থেকে সরকারিভাবে ইন্ডিয়া পরিচিত হবে ভারত নামে। যেমন এক সময়ের বার্মা এখন মিয়ানমার। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০তম আসিয়ান-ইন্ডিয়া সামিটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যোগদানের প্রাক্কালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে যে সরকারি নোটিফিকেশনটি ইস্যু করা হয় সেখানে প্রথমবারের মতো তাঁকে ইন্ডিয়ার পরিবর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে অবশ্য ভারতে তোলপাড়ও হয়েছে অনেক। চলছেও। নানাজন বিষয়টিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
ভারতের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্প্রতি সে দেশের বিরোধী দলগুলো যে নির্বাচনী জোট গঠন করেছে, তার নাম ‘ইন্ডিয়া’। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করছেন, বিরোধীদের ঐক্যে ভীত হয়ে মোদি সরকার তড়িঘড়ি অমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের অবশ্য অতশত জানা নেই। তার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না। তবে ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর এ বিষয়ে যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তাতে কোনো রাজনীতি দেখি না। জয়শংকর বলেছেন, ‘ভারত’ নামটিও তাদের সংবিধানেরই অংশ। ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখলাম, ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল ওয়ান বা প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ইন্ডিয়া অর্থাৎ ভারত হবে রাজ্যসমূহের ইউনিয়ন’।
অতএব ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ‘যাহাই ভারত, তাহাই ইন্ডিয়া’। সে ক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবেই যে প্রশ্নটি চলে আসে তা হলো, ভারত আর ইন্ডিয়া শব্দ দুটোর উৎপত্তি কোত্থেকে? প্রশ্নের উত্তর জানতে অবশ্যই ইতিহাসের দারস্থ হতে হবে। এত হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী যে দেশ ভারত, তার নামকরণের শিকড়টা দু-চার-দশ বছরের ইতিহাসে নিশ্চয়ই প্রোথিত নয়।
ইন্ডিয়া নামটি বস্তুত ভারতের ইংরেজি নাম এবং সংগত কারণেই নামটির ব্যাপক প্রচলনও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই। ইন্ডিয়া নামটির উৎপত্তি প্রাচীন গ্রিসে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের লেখায় প্রথম ইন্ডিয়া শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায়। ইন্ডাস রিভার, অর্থাৎ সিন্ধু নদের তীরবর্তী এবং এর অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলটিকে বোঝানোর জন্য হেরোডোটাস প্রথমবারের মতো ইন্ডিয়া শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। অ্যাংলো-স্যাক্সনদের কাছেও শব্দটি পরিচিত ছিল। তাদের রাজা আলফ্রেডের লেখায় ইন্ডিয়ার উল্লেখ আছে। মাঝে ফরাসি প্রভাবে ইন্ডিয়া পরিচিত ছিল এন্ডে নামে। তারও পরে প্রথমে ইন্ডি এবং পরবর্তীতে ১৭ শতক থেকে ইন্ডিয়া নামটির ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায় ইতিহাসে।
সিন্ধু নদ বা এই নদের আদি ফার্সি নাম ‘হিন্দু নদের’ ধারে যে জাতির বসবাস ছিল, তারাই ক্রমে পরিচিত হয়ে ওঠেন হিন্দু নামে। হিন্দু শব্দটি শুনতে কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের বোঝাতে ব্যবহার করা হতো না। শুরুতে শব্দটির ব্যবহার ছিল ইন্ডাস বা সিন্ধু নদের অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষকে বোঝানোর জন্য। আর এখান থেকেই হিন্দুস্তান নামটির উৎপত্তি। কারণ, সিন্ধু নদের অববাহিকায় বসবাসকারী হিন্দুদের যে মাতৃভূমি, তাই পরবর্তীতে হিন্দুস্তান বা হিন্দুদের দেশ নামে পরিচিত হয়েছিল। সে বিবেচনায় অবশ্য আজকের পাকিস্তানের জন্যই হিন্দুস্তান নামটি অনেক বেশি প্রযোজ্য। কারণ, সিন্ধু অববাহিকার প্রায় পুরোটাই এখন পাকিস্তানের অন্তর্গত।
অন্যদিকে ভারত নামটির উৎপত্তি এর ঢের আগে- হিন্দু পৌরাণিক সম্রাট ভরতের নামে। সম্রাট ভরতকে পা-ব, কৌরব. বৃহদ্রতা ও জরাসন্ধের পূর্বপুরুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঋগে¦দে তার অধীনের সাম্রাজ্যকে ভারত নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ভারতের অধিবাসী ভারতীয়রা ছিলেন বৈদিক জাতির উত্তরসূরি, যারা পাঞ্জাবের রাভি নদীর আশপাশের অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে বসবাস করতেন।
বিরোধী জোটের ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণের ভয়ে ভীত হয়ে মোদি সরকার ইন্ডিয়ার জায়গায় ভারত নামটিকে প্রতিস্থাপন করেছে এমন যুক্তি অনেকটাই হাস্যকর বলে মনে হয়। কারণ, ভারতের যে ঐতিহ্যবাহী দল কংগ্রেস, যার নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা, ভারতীয় উপমহাদেশের সেই প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটিও কিন্তু ইন্ডিয়াকে ভারত নামেই অভিহিত করত। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুখে মুখে সেই জমানায় জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘বলো বলো বলো সবে, শত বীণা বেণু রবে, ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’। কাজেই ভারতের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যদি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত দুটি নামের মধ্য থেকে ঔপনিবেশিক শাসকদের দেওয়া নামটি ঝেড়ে ফেলে ইতিহাসকে আপন করে নেয়, তাতে দোষের কি থাকতে পারে? আমরা নিজেরাও তো তাই-ই করেছি।
ব্রিটিশ পরবর্তী দুই যুগের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে আমাদের দেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আর আমরা ছিলাম না বাঙালি- পূর্ব পাকিস্তানি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যখন দেশটাকে স্বাধীন করলাম, তখন আমরা আমাদের জাতীয়তা হিসেবে বাঙালি আর বাঙালি জাতির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র অর্থাৎ, আমাদের বাসভূমিকে বাংলাদেশ নামেই নামকরণ করেছি। মাঝেই না বরং জিয়া আর তার দোসররা আমাদের বাংলাদেশী আর আমাদের দেশটাকে পাকিস্তান বানাবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল।
লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান,
ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ