
প্রসঙ্গ ইসলাম
প্রথম নবী হযরত আদম (আ.) দুনিয়ার প্রথম মানুষ। হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মানুষ সৃষ্টির আগে এ দুনিয়ায় জিন জাতিকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে বসবাস করতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুমের চরম অবাধ্য হয়ে দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল বলে আল্লাহ তাদের ধ্বংস করেন এবং মানুষকে তার খলিফার দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মহান নবী, রাসূলগণ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে সর্বপ্রথম হযরত আদম (আ.)-এর আলোচনা এসেছে।
কুরআনের অনুপম বর্ণনাধারা অনুযায়ী তা একই স্থানে সন্নিবেশিত নয়, বরং সর্ববৃহৎ সূরা আল বাকারা ব্যতীত আরও অন্তত ৮টি সূরায় তার প্রসঙ্গে বর্ণনা পাওয়া যায়। সূরাগুলো হলো আল ইমরান, মায়িদা, আ’রাফ, কাহাফ, বনী ইসরাইল, মারিয়াম, ত্বাহা ও ইয়াসিন।
আল্লাহতায়ালা যখন হযরত আদমকে (আ.) সৃষ্টির মনস্থ করলেন তখন ফেরেশতাদের উদ্দেশ করে বললেনÑ আমি অতি শীঘ্র মাটি দ্বারা একটি মাখলুক সৃষ্টি করব, যাকে ভূমণ্ডলে আমার খিলাফতের সম্মানে আসীন করব, যাকে ইচ্ছাশক্তির অধিকারী করা হবে, আমার পৃথিবীতে তার সর্বপ্রকার অধিকার সংরক্ষিত থাকবে, আর তাকে বলা হবে ‘বাশার’বা মানুষ। ফেরেশতাগণ এ কথা শুনে খুবই আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ! এ সৃষ্টির উদ্দেশ্য যদি এই হয় যে, তারা দিন-রাত আপনার ইবাদত করবে, আপনার হামদ্ সানা ও পবিত্রতা বর্ণনা করবে তবে তো আমরা পূর্ব থেকেই এ কাজগুলো করতে সদা প্রস্তুত।
আমরা তো বিনাবাক্যে আপনার আদেশ-নিষেধ মান্য করে আসছি। এর পরও ‘বাশার’ সৃষ্টির কী প্রয়োজন হলো? এমনও হতে পারে যে, আপনার এ মাখলুক পৃথিবীতে অকল্যাণ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে। হে আমাদের পরওয়ারদিগার! অবশেষে এরূপ সৃষ্টির মাঝে আপনার কি রহস্য নিহিত? (দ্র. ২:৩০)। ফেরেশতারা জানতেন, আল্লাহতায়ালার কোনো কাজই হিকমত থেকে খালি নয়। কিন্তু ওই হিকমত জানার প্রবল মানসিকতাই তাদেরকে এ প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। আল্লাহর কাজের সমালোচনা কিংবা প্রতিবাদ করার মনোবৃত্তি আদৌ ছিল না।-(আনোয়ারে আম্বিয়া, ২)। অনন্তর আল্লাহপাক মৃত্তিকাযোগে স্বীয় প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতম আকৃতিতে আদম দেহ তৈরি করে তন্মধ্যে ‘রূহ’ অর্থাৎ আত্মা সঞ্চারিত করলেন। পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) সঞ্জীবিত হয়ে উঠলেন।
উল্লেখ্য, আল্লাহ প্রথম আদমের (আ.) অবয়ব সৃষ্টির উপকরণ হিসেবে মাটি ব্যবহার করেন। মহান আল্লাহর হুকুমে হযরত জিব্রাইল (আ.) পৃথিবীতে এসে বর্তমান কা-বা শরীফের জায়গাটি থেকে এক মুষ্টি মাটি নিয়ে যান। এ মাটিতে পৃথিবীর সব অংশের মাটির বৈশিষ্ট্য ছিল। তা থেকেই সৃষ্টি করা হয় আদমকে (আ.)। কুরআনের আয়াতসমূহ বিশ্লেষণ করে হযরত আদমকে (আ.) সৃষ্টির ৬টি ধারাবাহিক পর্যায় পাওয়া যায়। যেমন-
১. প্রথম পর্যায় মাটি- কুরআন বলছে হযরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে।
২. দ্বিতীয় পর্যায় ত্বীন বা খামীর- যা মাটির সঙ্গে পানি মিশিয়ে বানানো হয়। সূরা সিজদার ৭নং আয়াতে বলা হয়েছে- মানুষ সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল মাটির খামীর থেকে।
৩. তৃতীয় পর্যায়- ত্বীনে লাসিব বা আঠাযুক্ত খামীর, যে খামীর অনেক দিন পড়ে থাকার ফলে আঠা সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ বলেন- নিশ্চয় আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি আঠাযুক্ত খামীর থেকে।
৪. চতুর্থ পর্যায়- হামায়িন মাসনূন অর্থাৎ ওই খামীর যাতে গন্ধ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
৫. পঞ্চম পর্যায়- ওই খামীর যা গন্ধযুক্ত হওয়ার পর শুকিয়ে পোক্ত হয়ে গেছে। সূরা আল হিজরের ২৬নং আয়াতে বলা হয়েছে- আমি পচা কর্দম থেকে তৈরি বিশুষক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্ট একটি মানব জাতির পত্তন করব।
৬. ষষ্ঠ পর্যায়- ‘বাশার’ বা মাটির চূড়ান্ত অবস্থা যাতে আল্লাহ রূহ প্রবিষ্ট করেছেন। (দ্র. সূরা ছোয়াদ, ৭১-৭২)।
যেহেতু আল্লাহতায়ালা আদমকে (আ.) পৃথিবীতে নিজের খলিফা বা প্রতিনিধি নির্বাচনের অভিমত প্রকাশ করেছিলেন সেহেতু তিনি তাকে সিফাতে ইলাহিয়ার সর্বোত্তম সিফাত ‘ইলম’ বা জ্ঞান দ্বারা তাকে গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত করেছিলেন। তিনি আদমকে জগতের সমস্ত বিষয়ের নাম শিক্ষা দিলেন। পৃথিবীর যাবতীয় জিনিসের বাহ্যিক পরিচয় ও লক্ষ্যণাদি এবং গুণাবলী ব্যাপকভাবে তাকে শিক্ষা দিলেন। এমনকি সমস্ত জিনিসের গোপন রহস্য তিনি তাকে অবহিত করলেন। অতঃপর- ফেরেশতাগণকে ওই সমস্ত জিনিসের নাম বলতে আদেশ করলেন। ফেরেশতাগণ অসমর্থ হয়ে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেন এবং বললেন- ওহে আমাদের রব! আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন এ ছাড়া তো আমাদের আর কোনো জ্ঞান নেই।
অনন্তর আল্লাহ তায়ালা আদমকে (আ.) এ সমস্ত বস্তুর নাম বলতে আদেশ করলে আদম সব কিছুর (বাহ্যিক ও গোপন) গুণাবলী বলে দেন। (দ্র. ২: ৩১-৩৩)। এভাবে মহান পরওয়ারদিগারে আলম আল্লাহতায়ালা আপন মহিমা ও অনুগ্রহে মাটির মানুষকে ফেরেশতাকুলের চেয়ে বেশি জ্ঞানী-গুণী, মর্যাদাসম্পন্ন করে গড়ে তুললেন। মানুষকে তিনি উন্নীত করলেন আশরাফুল মাখলুকাত বা ‘সৃষ্টির সেরা’ জীবের আসনে। উপরন্তু মানুষ আনুগত্য, আদব ও শিক্ষার পাবন্দ হয়ে আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
যখন আদমের (আ.) অস্তিত্ব প্রকাশমান হলো এবং তাকে জ্ঞান দ্বারা মর্যাদাবান করা হলো তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের উপর আদমের (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চমর্যাদা প্রকাশার্থে তাকে সিজদা করার আদেশ দেন। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদেরকে আদমের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকারের নির্দেশ করেন। একমাত্র ইবলিশ ব্যতীত সকল ফেরেশতা বিনাবাক্যে আল্লাহর নির্দেশমতো আদমকে (আ.) সিজদা করেন। কিন্তু ইবলিশ মৃত্তিকাজাত আদমকে (আ.) সিজদা করতে অহঙ্কার ও অবজ্ঞার সঙ্গে অস্বীকার করে।
আল্লাহর এ আদেশ অমান্য করে ইবলিশ অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হলো। (দ্র. ২ : ৩৪, ৭ : ১১, ১৫ : ২৬-৩১, ১৮ : ৫০, ৩৮ : ৭১-৭৪)। অহঙ্কার, আত্মম্ভরিতা ও অজ্ঞতার কারণেই ইবলিশ আল্লাহর হুকুম অমান্য করল এবং তার সান্নিধ্য থেকে বিতাড়িত ও বহিষ্কৃত হলো। এমনি অবস্থায় সে কিয়ামত পর্যন্ত তার দীর্ঘায়ুর জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল। আল্লাহতায়ালা তার প্রার্থনা কবুল করলেন এবং তাকে কিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘায়ু দান করলেন।
ইবলিশ আদমের (আ.) প্রতি হিংসাপরবশ হয়ে বলল- হে আল্লাহ! আমি আদমকে আপনার পথ থেকে বিচ্যুত করব।
আপনার সঙ্গে চলার প্রতি বাধা সৃষ্টি করব। আদমের বংশধরকে আপনার অকৃতজ্ঞ বান্দা বানিয়ে এবং অন্যায় ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত করব। জবাবে আল্লাহতায়ালা বললেন- তুমি তোমার কাজ করতে থাক। আমার মুখলেস বান্দারা তোমার ধোঁকায় কখনো পড়বে না। হ্যাঁ, যারা তোমার অনুসরণ করবে তারা তোমার সঙ্গেই জাহান্নামি হবে। কুরআন মাজীদের বেশ কয়েকটি জায়গায় এই বর্ণনা এসেছে। যেমন: সূরা ছোয়াদের ৭৫-৮৫,আ’রাফের ১২-১৮, হিজরের ৩২-৪৪ ও সূরা ইরসা ৬১-৬৫নং আয়াতে এসেছে।
পৃথিবীর কালপরিক্রমায় মানব সভ্যতা প্রমাণ করল, আল্লাহর ইচ্ছাই সঠিক। যুগে যুগে বেশিরভাগ বান্দাই তাঁর জন্য আত্মোৎসর্গ করেছে, তাঁর অনুশাসনে জীবন অতিবাহিত করেছে এবং তাঁরই বিধান প্রচারে বিশ্বে আত্মোনিয়োগ করেছে। এ মানব জাতিই জ্ঞান-বুদ্ধির বদৌলতে বসুন্ধরাকে নবতর পন্থায় সমৃদ্ধ করে চলেছে। পক্ষান্তরে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ফ্যাসাদী ও সত্যবিমুখ তারা খুবই নগণ্য। এরাই শয়তানের অনুসারী। কোনো না কোনো পর্যায়ে তারা লাঞ্ছিত ও পতিত হয়। ইতিহাসের এ এক চিরন্তন সত্য, এ এক অনুধাবনের বিষয়।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব