ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংকট নিরসনে করণীয়

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ১০ জুন ২০২৩

সংকট নিরসনে করণীয়

মো. সাখাওয়াত হোসেন

বর্তমান বিশ্ব এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে পৃথিবীর এক প্রান্তে কোনোরূপ সমস্যা সৃষ্টি হলে অন্য প্রান্তের বাসিন্দারা এর প্রভাব অনুভব করে থাকে। অর্থাৎ পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজ এবং এই পরিস্থিতিতে প্রত্যেক রাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। বাণিজ্যিক কারণেই এক রাষ্ট্র অন্যের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বায়নের বাস্তবতায় নানাবিধ কারণে রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরস্পরের নির্ভরশীল। সে কারণেই দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধময় পরিস্থিতিতে পুরো পৃথিবীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।

রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মেরুকরণ হয়ে পৃথিবী কয়েকটি পোলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর কারণে ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে থাকা অগণিত নিরীহ মানুষকে। বুদ্ধিজীবীগণ মতামত প্রদান করছেন, সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, যদি না যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান ঘটে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে না যে, শীঘ্রই পরিস্থিতির অবসান হতে যাচ্ছে। সে কারণেই যত ধরনের সংকটের আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে, তা মোকাবিলায় হতে হবে কৌশলী।  
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বিদ্যুতের ঘাটতি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্যুতের ঘাটতি সংক্রান্ত পক্ষে বিপক্ষে অনেক মন্তব্য এসেছে। তথাপি সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণার্থে আমাদের তুলনামূলকভাবে আগ্রহ কম। আমরা সাশ্রয়ী হওয়ার বিষয়ে তেমন সচেতন নই। যে কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন, তা হচ্ছে জ্বালানি সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনার বিষয়ে যেভাবেই  হোক দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন। তাছাড়াও বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়ার বিকল্প নেই।

অপ্রয়োজনে সারাদেশে বিদ্যুতের লাইট, ফ্যান ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির ব্যবহার পরিমিত রাখার ক্ষেত্রে সকলকে ভূমিকা রাখতে হবে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণও পারে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হতে। সারাদেশে অসংখ্য অবৈধ সংযোগের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার খবরের পাতায় শিরোনাম প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে দেশের সকল পর্যায়ের জনসাধারণের সচেতনতার বিকল্প নেই। দেশের কল্যাণার্থে সকল পেশা শ্রেণির মানুষের ঐক্যের বিকল্প নেই। 
জ্বালানি সংকটের কারণে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অচিরেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে; নতুন কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে এবং তখন এই সংকট থাকবে না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেশিরভাগই গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে প্রাকৃতিক এবং আমদানি করা এলএনজি রয়েছে। কয়লাভিত্তিক এবং তেলচালিত যেসব কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগও আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ এসব কেন্দ্রের পুরো জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করে আনতে হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫১.০৫ শতাংশ গ্যাসনির্ভর, ফার্নেস অয়েলের ওপর নির্ভরশীল ২৮.১৫ শতাংশ, ডিজেলচালিত কেন্দ্র থেকে ৫.৭৪ শতাংশ আর কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৭.৮৬ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার বড় একটি অংশ নির্ভর করছে আমদানি করা জ্বালানির ওপর। বেসরকারি উদ্যোগে যে ৯,৯৪৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে, এগুলো পুরোপুরি বিদেশ থেকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল।
আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, তেল ও কয়লার দাম বাড়া বা কমার প্রভাব পড়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতে। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্ব বাজারে তেল, এলএনজি এবং কয়লার দাম বেড়ে যেতে শুরু করেছে। ফলে, শুরুতে যেভাবে হিসাব করা হয়েছিল, সেই তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ অনেক বেড়ে যায়। যুদ্ধ পরিস্থিতি, মন্দাবস্থা, আন্তর্জাতিক বাজারনীতি এবং বাড়তি দামের কারণে বিশ্ব বাজার থেকে জ্বালানি ক্রয় করে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করার ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিকূলতা দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস এবং কয়লার দাম কম ছিল। এই কারণে মনে করা হয়েছিল, দেশে গ্যাস বা কয়লা উত্তোলন করতে যে খরচ হবে, সে তুলনায় আমদানি করলে খুব একটা পার্থক্য তৈরি হবে না। এসব কারণে দেশের ভেতর জ্বালানির উৎস খোঁজার পরিবর্তে আমদানিনির্ভর কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে জ্বালানি নীতি। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে ২০১৬ সালে যে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সেটা বিশ্লেষণ করলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জ্বালানির ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হবে।
বাংলাদেশে ডিজেলচালিত ১০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে ১২৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে। এর বাইরে ৬৪টি কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয় ফার্নেস অয়েল, যেখান থেকে বিদ্যুৎ আসার কথা ৬,৩২৯ মেগাওয়াট। এই দুটি মিলিয়ে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৪ শতাংশ। এসব কেন্দ্র পুরোপুরি আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে। দেশে কিছু ফার্নেস অয়েল পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। মূলত গ্যাস সংকট তৈরি হওয়ার পর বিদ্যুতের দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে এসব কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম ছিল।
বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসচালিত ৫৭টি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ১১,৪৭৬ মেগাওয়াট। ঠিকমতো গ্যাস না পাওয়ায় এসব কেন্দ্র পুরো সক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না। দেশে যেখানে গ্যাসের গড় উৎপাদন হচ্ছে ২৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চাহিদাই রয়েছে ২১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে, সেখানেও সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে। দেশে শিল্পকারখানা, আবাসিক মিলে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ৩৩ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। বাকিটা প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে আমদানি করা এলএনজি দিয়ে পূরণের চেষ্টা করা হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া দামের কারণে এলএনজি আমদানিতেও ভাটা পড়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে তিনটি। এর মধ্যে দিনাজপুরের বড় পুকুরিয়া খনিতে উৎপাদিত কয়লা দিয়ে সেখানকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চলে। এটির মোট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ৫২৫ মেগাওয়াট। বাকি যে দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে, তার একটি পায়রা, অন্যটি রামপাল। এই দুটি কেন্দ্রই আমদানি করা কয়লার ওপর নির্ভরশীল করে তৈরি করা হয়েছে। এসব কেন্দ্র চালুর আগে সরকারের পক্ষ থেকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, এগুলো পুরোপুরি চালু হলে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ কমে যাবে এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি অনেকটা মিটবে। কিন্তু কয়লা সংকটের কারণে এই মাসের শুরুতেই পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত এ সকল কারণেই দেখা দিয়েছে সংকট। 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে জ্বালানির জন্য আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তারা মনে করছেন, সরকারের উচিত সৌর বিদ্যুতের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে কার্যকরী জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস অনুসন্ধান আরও জোরদার করা দরকার। জ্বালানি নিরাপত্তার একটা পূর্বশর্ত হলো, অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। কাজেই, আমদানির পাশাপাশি নিজস্ব সম্পদও কাজে লাগাতে হবে। আশা করা যাচ্ছে, ১৩ জুন থেকে এস আলমের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হবে, ২২ জুন থেকে পায়রা আবার উৎপাদনে যাবে, আদানি পাওয়ার ইউনিট থেকে ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ আসতে শুরু করেছে। ফলে, অচিরেই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হতে পারে।

লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×