ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

তন্ময় চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:৪২, ১ এপ্রিল ২০২৩

তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

পোশাক রপ্তানির বিশ্ববাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী

বাংলাদেশ এবং চীন দীর্ঘদিনের বন্ধুরাষ্ট্র। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় চীন আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদারও বটে। অথচ সেই চীনকে এখন প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে বাংলাদেশ। তবে সেটা ভূরাজনৈতিক কারণে বা কৌশলগত জোটে অংশগ্রহণ নিয়ে না, বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে শীর্ষস্থান চীনের দখলে থাকলেও দ্বিতীয় স্থানে বসে ঘাড়ের ওপরে নিশ্বাস ফেলছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা এখন শুধু একটি দেশের সঙ্গে, সেটা হলো চীন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে এক দফা বাজার হারায় তৈরি পোশাক রপ্তানির বিশ্ববাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী চীন। বাণিজ্যযুদ্ধ কিছুটা শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আঘাত হানে করোনাভাইরাস। পরপর দুই আঘাতে রপ্তানিবাজারে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে চীন। স্বাভাবিক কারণেই চীনের হারানো বাজার হাতছানি দিয়েছিল অপরাপর প্রতিযোগীদের। আন্তর্জাতিক পোশাক বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই চীনের পরের অবস্থানটি ছিল বাংলাদেশের। ফলে, স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এ দেশের রপ্তানিকারকরা। স্বপ্ন কিছুটা পূরণ হয়েছিল বটে, কিছুদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাক রপ্তানিতে চীনকে টপকে শীর্ষস্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) চীনের বাজার থেকে সবচেয়ে বেশি পোশাক আমদানি করে। কিন্তু গতবছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশটিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের পণ্যের পরিমাণের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনটা জানা গেছে। ইউরোস্ট্যাটের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইইউর বাইরের দেশগুলো থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি–নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ৯ হাজার ৫১৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে ইইউভুক্ত ২৭টি দেশ।

তার মধ্যে ২ হাজার ৭৯৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে চীন। দেশটির এই রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে একই সময়ে অর্থাৎ ২০২২ সালের প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশ থেকে ইইউতে ২ হাজার ১১৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে দ্বিগুণ ৩৮ শতাংশ। মন্দার শঙ্কার মধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধান বাজারগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। দেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাকের চালান প্রায় ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাছাড়া ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের বাজারে ৩ হাজার ২৫ কোটি ৯৬ লাখ পাউন্ডের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা একক বছর হিসাবে এই বাজারে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পোশাক। বৈশ্বিক মন্দা এবং করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে পোশাক রপ্তানিতে কিছুটা ভাটা পড়লেও দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। অবশ্য বরাবরের মতো যুক্তরাজ্যের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে প্রথম অবস্থান ধরে রেখেছে চীন।
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার। ৯ বছর আগে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বাজারটিতে রপ্তানি কমে যায়। তারপর কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক সংস্কারকাজ করেন উদ্যোক্তারা। ফলে, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি। পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রায় ২১.৫ শতাংশ এই বিশাল বাজার থেকে এসেছে। বাংলাদেশ সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করে, অন্যদিকে মার্কিন ক্রেতারা গার্মেন্টেসের নিরাপত্তার মান নিয়ে খুশি।

অন্যান্য দেশের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একটি অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে এবং সেখানে সুদের হার এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, সেখানের মানুষ এখনো কাপড় ক্রয়ে আগ্রহী। দেশটির আমদানি পরিসংখ্যানও নির্দেশ করছে যে, মার্কিন শিল্প ও অর্থনীতি কোভিড-১৯ সংকট থেকে দ্রুতই পুনরুদ্ধার হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত রপ্তানির পথ খুলে দিলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি আরও বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে সর্বত্র প্রয়োজনীয় পোশাক রপ্তানি করছে এবং এই চাহিদা ইউরোপের বাজারে অনেকাংশে বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের আলামত দৃশ্যমান হওয়ায় ইইউ প্লাস দেশ, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্রমাগত বৃদ্ধির প্রত্যাশা করা যায়। আবার, আগামীদিনে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্রমবর্ধমান থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র প্রধান আমদানি উৎস হিসেবে চীন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে।

রপ্তানিকারকরা আরও বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় বাংলাদেশ এর সুফল পাচ্ছে। চীনে পোশাক তৈরির খরচও বাংলাদেশের থেকে বেশি, তাই আমদানিকারক দেশগুলো বাংলাদেশের মুখাপেক্ষী হচ্ছে। মিয়ানমার ও ইথিওপিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অতিরিক্ত ক্রয়াদেশ পাচ্ছে, যা আমাদের জন্য ইতিবাচক।
বিশ্বসেরা ১০০টি তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে ৫১টিই বাংলাদেশের। উৎপাদন পর্যায়ে এমন বিনিয়োগের পর প্রতিযোগিতার বাজার দখলেও বর্তমানে বেশ আত্মবিশ্বাসী দেশের উদ্যোক্তারা। ক্রেতার আস্থা অর্জনের সেই প্রতিচ্ছবিই উঠে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাক রপ্তানির হালনাগাদ তথ্যে। ইউরোপের বাজারে আস্থার জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এই ধারা অব্যাহত থাকলে একসময় বাংলাদেশ ইউরোপে সবচেয়ে বেশি গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক দেশ হবে। ইতোমধ্যে ডেনিম ও টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থান দখল করেছে, অন্যান্য সেকশনেও বাংলাদেশের উন্নতি ঈর্ষণীয়।
পোশাক রপ্তানি খাতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় আর চীন প্রথম, গত দশক পর্যন্ত এমনই ছিল প্রচলিত তুলনা। তবে গতবছর অন্তত ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধিতে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। স্থায়ীভাবে চীনকে টপকে শীর্ষস্থান দখলের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরাও। তবে এটা সত্য যে, আমরা নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছি। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, সামনে হয়ত মজুরিও বাড়বে।

আবার স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে ২০২৯ সালের পর পণ্য রপ্তানিতে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপি পাব না আমরা। তাই এখন থেকেই আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আশা করা যায় যে ইইউ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব এবং নিজেদের কূটনৈতিক সাফল্যের মাধ্যমেই বাংলাদেশ একদিন চীনকে ছাড়িয়ে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষস্থান নিশ্চিত করতে পারবে।

লেখক : গবেষক

×