ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিজ্ঞানচর্চা ও শিল্প-সংস্কৃতি

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩

বিজ্ঞানচর্চা ও শিল্প-সংস্কৃতি

বিজ্ঞানচর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে সভা-সেমিনার। বিজ্ঞানকে জানতে কিংবা জানাতে সভা-সেমিনারের কোনো বিকল্প নেই

বিজ্ঞানচর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে সভা-সেমিনার। বিজ্ঞানকে জানতে কিংবা জানাতে সভা-সেমিনারের কোনো বিকল্প নেই, তা সে চিকিৎসা বিজ্ঞানই হোক কিংবা হোক অন্য কোনো বিজ্ঞান। এমনি বিজ্ঞানময় একটি দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এ যাত্রায় লিখতে বসা। দিনের শুরুটা কাটল চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যস্ততায়। বাংলাদেশে একটা সময় আয়ুর্বেদ আর হেকিমী এই দুই চিকিৎসাশাস্ত্রের ব্যাপক প্রচলন ছিল। কারণটাও খুবই সঙ্গত।

মাত্র সাতান্ন হাজার তিনশত বিশ বর্গমাইলে এত বেশি সংখ্যক মুসলমান আর হিন্দু জনগোষ্ঠী এবং অন্য ধর্মেরও এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান পৃথিবীতে তেমন বেশি দেখা যায় না। হেকিমী মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাশাস্ত্র আর আয়ুর্বেদটা ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বীদের। কালের বিবর্তনে আমরা অবশ্য সেই ঐতিহ্য পুরোপুরি হারিয়ে বসেছি। আজ আমাদের কাছে, বিশেষ করে আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আয়ুর্বেদ বা হেকিমী শাস্ত্রকে আর যাই হোক না কেন বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা বলে একেবারে গণ্য করেন না।

আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাশাস্ত্রগুলোর অবক্ষয়ের সূচনাটা সম্ভবত ব্রিটিশ শাসনামলে। ব্রিটিশরাজ সুকৌশলে আমাদের এই ভূখ-ে প্রচলিত ট্রাডিশনাল চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোকে এ্যালোপেথি দিয়ে প্রতিস্থাপন করে দিয়েছিলেন। তবে যা শেষ হয়ে যায়নি তা হলো এ বিষয়ে আমাদের রেসিডুয়াল জ্ঞান। আজও কোন রোগে কোন ঔষধি গাছ কাজে আসবে এ নিয়ে জানতে আমাদের বেশি দূরে যেতে হয় না। ঘরের মা-খালাদের প্রশ্ন করলেই তারা বলে দেবেন ব্লাডপ্রেসারে স্বর্পগদ্ধা কত বড় ওষুধ, ডায়াবেটিস কিভাবে সারিয়ে দেয় নিমের পাতা কিংবা রসুন দিয়ে হৃদযন্ত্রের আর কালোমেঘ দিয়ে লিভারের চিকিৎসার নানা তথ্য।

সমস্যা হচ্ছে যে, কালোমেঘ খেয়ে যদি কমেও যায় লিভারের চর্বি কিংবা নিমের তেতোয় কমে যায় ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের মিষ্টি তাতে কিন্তু এখনকার দিনে আর বিজ্ঞান হয় না। আজকের আধুনিক বিজ্ঞানে প্রমাণ করতে হয় কালোমেঘের বিশ-বাইশটি উপদানের মধ্যে কোন্ উপাদানটি লিভারের চর্বি কমায় আর যদি কমায়ও তবে তা কিভাবে। এসব যে পদ্ধতিতে করা হয় তার নাম ডকিং।

করতে হবে এইচপিএলসিও, অর্থাৎ পরীক্ষাগারে প্রমাণ করতে হবে কতটুকু ডোজে ওষুধটি খাওয়ালে তা কার্যকর হবে। শুধু তাই নয়, তারপরও চাই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। মানুষে তো বটেই, প্রয়োজনে প্রাণীতেও, তবেই হবে বিজ্ঞান। তবেই আজকে বলা যাবে আমাদের গতকালের যে চিকিৎসাশাস্ত্র, আমাদের যে ঐতিহ্যবাহী ঔষধি গাছ-গাছরা, সেসব আসলেই বিজ্ঞানসম্মত কিনা!
আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানী। কাজেই মানুষকে ওষুধ খাইয়ে তার কার্যকারিতা প্রমাণ করা আমার জন্য সহজ। কিন্তু ডকিং বা এইচপিএলসি-এর মতন কাঠখোট্টা বিষয় আমার বৃত্তের বাইরে। দীর্ঘদিন ঔষধি গাছ-গাছরা নিয়ে কাজ করার আগ্রহ থাকলেও সুযোগের অভাবে করে উঠতে পারছিলাম না। গত ক’বছরের চেষ্টায় অবশ্য সেই ঘাটতিটা কাটিয়ে উঠেছি। দেশের একাধিক পাবলিক আর প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় এবং শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে রিসার্চ কোলাবরেশন গড়ে তুলতে পারার কারণে সীমবদ্ধতাগুলো আমরা এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারছি।

সেদিন সকালের সেমিনারটি আমাদের জন্য  বিশেষভাবে তাৎপর্যপূণ। কারণ, ঐসব ডকিং আর এইচপিএলসির হার্ডেল ডিঙ্গিয়ে আমরা এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে কালোমেঘ দিয়ে লিভারের চর্বি বা ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটির শুভ সূচনা করলাম। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বিশ^বিদ্যালয়ের শীর্ষকর্তা, ছিলেন সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী আর মিডিয়ার সহমকর্মীরাও। যাকে বলে দারুণ এক অনুভূতি। মহান কোনো বিজ্ঞান করার আনন্দে নয়, অনুভূতিগুলো অন্যরকম।

কারণ, যে আয়ুর্বেদ হাল জমানায়, হাল আমলের চিকিৎসায় অনেকটাই অপাঙক্তেয় সেই গাছ-গাছালি নিয়ে সেমিনার হচ্ছে দেশের শীর্ষ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে আর তা মন দিয়ে শুনছেন যার যার পেশার সেরা মানুষগুলো, এর  চেয়ে বড় আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে?
আয়ুর্বেদ বিষয়ক সভাটি শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি রেস্তোরাঁ। সেখানে আড্ডা হবে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের ক’জন সাহিত্যসেবী আর প্রকাশকের সঙ্গে। দুপুরের খাবারের ফাঁকে ফাঁকে আর খাবার শেষে চা-কফির কাপে ধোঁয়া তুলে যে তুমুল আড্ডা তার বিষয়বস্তু দুই বাংলার সাহিত্য আর প্রকাশনা হলেও এর অন্তর্নিহিত বিষয়টি হচ্ছে বাঙালীর বাঙালিয়ানা আর বাঙালিত্ব। কাঁটাতারের বেড়া আর পাসপোর্টের ভিন্নতা বাঙালিকে আজ দু’দেশের নাগরিক করেছে ঠিকই, কিন্তু বাঙালিয়ানার যে ঐকতান পদ্মায়-গঙ্গায় তাকে বিভক্ত করে সেই শক্তি কোথায়?
তারপরও বাস্তবতাটা এই বাঙালিকে মুসলমান আর হিন্দু দু’জাতিতে বিভক্ত করে এক বাঙালিকে দ্বিখ-িত করার এই যে প্রক্রিয়া সেই ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা অবশ্যই অব্যাহত ছিল পাকিস্তানের চব্বিশ বছরেও, আর তারপরে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর থেকে। আজ যখন এ দেশে বঙ্গবন্ধুর কন্যা সরকারে টানা তিন মেয়াদের শাসনে রচিত হচ্ছে একের পর এক সাফল্যগাথা তখনো কিন্তু স্বীকার করে নিতে হবে যে, এই একটি জায়গায় আমরা একাত্তরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এখনো পিছিয়ে আছি।

আর এই যে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ, কাঁটাতার আর ভিসার বাধাকে ডিঙ্গিয়ে বাঙালীর বাঙালিত্ব এবং একক জাতিসত্তার লালন করার এই যে অত্যাবশ্যকীয় তাগিদ তা মানুষে মানুষে যোগাযোগ ছাড়া অসম্ভব। সরকারের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ যতই প্রগাঢ় হোক না কেন মানুষ যদি মানুষকে না চেনে, না বোঝে তবে তার জন্য পস্তাতে হবে বাঙালিকেই। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মননশীল বাঙালিদের মননশীলতায় এ ধরনের বিনিময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ঢাকার সিলেটীদের সংগঠন সিলেট জেলা সমিতির বৈঠকে যোগ দেওয়া। দেশের সিলেট জেলা যাদের স্থায়ী ঠিকানা, কিন্তু পেশা কিংবা অন্য কোনো কারণে যাদের অবস্থান এখন রাজধানী ঢাকায়, এমনি কিছু প্রতিষ্ঠিত মানুষের ‘ঘরের খেয়ে, বনের মোষ তাড়ানোর’ দারুণ এক প্ল্যাটফর্ম সংগঠনটি। এখানে আছেন সরকারের সচিব থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, গৃহবধূ কে নন?

তাদের বয়সে আর পেশায় যতই ভিন্নতা থাকুক না কেন মিল দুটি জায়গায়। তারা প্রত্যেকেই সিলেট এবং তাদের দারুণ আগ্রহ সিলেট আর সিলেটীদের জন্য ভালো কিছু করা। সংগঠনটির সঙ্গে আমার সম্পৃক্তা হালের, কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, দেখছি আর মিশছি যত মুগ্ধতা বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমানুপাতিক হারে।
দিনব্যাপী চিকিৎসা বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর সবশেষে সমাজবিজ্ঞান, অগত্যা যখন চেম্বারে তখন মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক আজকের পৃথিবীতে বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আমরা আসলে কেউ কিছু নই। বিজ্ঞান যে আমাদের কতভাবে প্রভাবিত করে এ তার নগণ্য নমুনা মাত্র। বিজ্ঞানময় এই সময়টায় থাকতে হলে বিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। একজন নিবেদিতপ্রাণ মহীয়সী নারী যখন স্বাধীনতা দিবসে দেশের তৈরি রকেট উড়িয়ে ডিজিটাল দেশটাকে স্মার্ট বানানোর বিজ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত তখন ঠিক একই সময় আরেকদল মানুষ সমাজবিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে চেষ্টা করছে ঘড়ির কাঁটাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিতে। তারা প্রায়ই ছাড়িয়ে যাচ্ছেন সহ্যের সীমানাগুলো, যখন তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ছুড়ে ফেলে দিতে চায় বুড়িগঙ্গার পানিতে, কিংবা ভরা মজলিশে উদ্যত ভঙ্গিতে বলে বসে, এদেশের স্বাধীনতা নাকি ‘বাইচান্স’। অথচ আমাদের সাফল্যেরই ইয়ত্তা নেই। তাহলে এই জায়গাটায় কেন আমাদের সাফল্যের পাল্টাটা এখনো উল্টোদিকেই ভারি।
সারাদিন ধরে ত্রিমুখী বিজ্ঞানচর্চা করে রাতে এসে মনে হলো উত্তরটা বোধ হয় খুঁজে পেয়েছি। ওরা আমাদের ঘায়েল করতে চাইছে সমাজবিজ্ঞানে। আর সেই জায়গায় আমদের উদ্যোগগুলো সবটুকুই উন্নয়নকেন্দ্রিক। জিততে আমাদের তাই এত বেশি কষ্ট। কুকুর যেমন তার জন্য মুগুরটাও হওয়া চাই তেমনি। আমরা বারবার জিতছি ঠিকই, কিন্তু তারা ঠিকই আবারও ছোবল দিতে উদ্যত হচ্ছে। এদের ফণাটা পাকাপাকিভাবে মুচড়ে দিতে হলে আমাদের জোর দিতে হবে সমাজবিজ্ঞানের জায়গাটাতেও।

ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদ শাস্ত্রটার মতো মনোযোগী হতে হবে আমাদের গর্বের সংস্কৃতি আর কৃষ্টির ওপর। শীতের গ্রামবাংলায় যাত্রাপালা আর পটের গান কিংবা পুঁথিপাঠের সেই হারানো আসরগুলো যেমন ফিরিয়ে আনতে হবে, তেমনি ফিরিয়ে আনতে হবে বৈশাখী মেলাগুলোকে শহরে ও গ্রামে। আমরা যদি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে গিয়ে বারবার ভুল করে বসি, কে জানে সেই ভুলের জন্য একদিন হয়ত আমাদের অনেক বেশি মাশুল গুনতে হতে পারে। 
লেখক : ডিভিশন প্রধান,
ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও 
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

×