ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বীর সন্তানদের স্মরণের দিন

ড. সাজ্জাদ হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২

বীর সন্তানদের স্মরণের দিন

বুদ্ধিজীবী দিবস

পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল স্বাধীন হয়েছে। কোথাও কোথাও উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। ঠিক এমন সময় বাঙালির বীর সন্তানদের হত্যার নীলনকশা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নিজেদের অনিবার্য পরাজয় বুঝতে পেরে তাদের এদেশীয় দোসর, রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের মাধ্যমে চূড়ান্ত আঘাত হানে। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মাত্র দুদিন আগে জাতির সবচেয়ে মেধাবী লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। সারাদেশে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪২ জন আইনজীবী, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৯ জন শিল্পী ও সাহিত্যিক এবং ৫ জন প্রকৌশলী দেশমাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গ করেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রদত্ত বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকা-ের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ঐ সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী।’ সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নির্দেশিত হলেও ১৪ ডিসেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালি জাতি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে শ্রদ্ধাভরে পালন করে আসছে।
’৪৭-এর দেশ ভাগ ও তার পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে পূর্ব বাংলায় নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষিত সমাজ। তাদের সঙ্গে দেশের সর্বস্তরের জনগণ অংশ নিয়েছে। পরে দীর্ঘমেয়াদে যা মুক্তি সংগ্রামে রূপ নেয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজ তথা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকেই এসেছিল। ফলে শাসকগোষ্ঠী এই বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রভাব বুঝতে সক্ষম হয়। একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যার মাধ্যমে শুরু হয়ে দীর্ঘ নয় মাসই দেশের বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। কারণ, ইতোপূর্বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরে, সৃষ্টিশীল কর্মের পাশাপাশি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়ে শাসকদের চক্ষুশুল হয়েছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত চলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-।
১৪ ডিসেম্বরে যারা শহীদ হন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- দার্শনিক অধ্যাপক গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব (জি সি দেব); ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা; মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী- গবেষক, বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক; সিরাজুদ্দীন হোসেন- বিখ্যাত সাংবাদিক ও দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক; সেলিনা পারভিন- সাংবাদিক ও সাহিত্যিক; ডা. আবদুল আলিম চৌধুরী- চক্ষু বিশেষজ্ঞ; আলতাফ মাহমুদ- সংগীতজ্ঞ-‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের সুরকার; মুনীর চৌধুরী- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও নাট্যকার; শহীদুল্লাহ কায়সার- প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক এবং জহির রায়হান- প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বরে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ১ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের প্রস্তুতি শুরু করে হানাদার বাহিনী এবং ১৪ ডিসেম্বর এই ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় চূড়ান্তভাবে। অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখক ও দার্শনিকসহ প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা অপহরণ করে নিয়ে যায়। অনেককে তাদের নিজ বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়।

চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ বিভিন্ন স্থানে আটকে রেখে অকথ্য নির্যাতন শেষে নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করে লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুরের বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও জাতির হৃদয়ে গভীর ক্ষত থেকে যায়, যা রক্তের অমোচনীয় কালিতে লেখা। ১৪ ডিসেম্বর বাঙালির সেই বিষাদের দিন। তাদের আদর্শে এই দেশকে গড়ে তুলতে পারলে ঋণ কিছুটা হলেও পরিশোধ করা সম্ভব। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের অহংকারের দিন।

তবে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, এই দিনটিকে অর্জন করতে বাঙালিকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিসর্জন, সম্ভ্রমহারা মা-বোনের আহাজারি, বাড়িঘর উচ্ছেদ ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যে অধিকতর অগ্রগতি অর্জন করতে পারত নিঃসন্দেহে। মূলত বাঙালির আত্মপরিচয় ও প্রকৃত আদর্শ ধারণের কারণেই হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের। বুদ্ধিজীবীদের একটি রাষ্ট্রের বিবেক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

বিশেষ করে একটি নবগঠিত রাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ, রাষ্ট্র মানে শুধু একটি ভূখ- নয়, দেশের চিরায়ত শিল্প-সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, সমাজের মেলবন্ধনে একটি রাষ্ট্র রূপ পায়। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকা- দেশে এক চরম শূন্যতা তৈরি হয়, যা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন তথা জাতি-গঠনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ দেখলেই সুস্পষ্ট হয় যে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- কোনো সাময়িক ফলাফলের জন্য সংঘটিত হয়নি। পরাজয় এড়ানোর কোনো পথই যখন অবশিষ্ট ছিল না তখন এই হত্যাকা-ের ছক কষে পাকিস্তানিরা। পূর্ব পাকিস্তান নামক ভূখ- হাতছাড়া হওয়ার পর এই রাষ্ট্র যেন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে পরিকল্পনার বহির্প্রকাশ ছিল ১৪ ডিসেম্বরের নৃশংস হত্যাকা-। এদিন সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবীর জীবন কেড়ে নেওয়া হয়। এটি ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য ও দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করার চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত।
১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বরের ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত না হলে বাংলাদেশ বহু আগেই বিশ্বের বুকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করত। তবে বিলম্বে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ও কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্মিলন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। তবে ডিসেম্বর মাস এলে এখনো একাত্তরের পরাজিত শক্তি মাথাচড়া দিয়ে উঠতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত জনসভায় বলেছেন, ‘জাতির পিতার নেতৃত্বে এই মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল।

আমরা বিজয়ী জাতি। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা, আদর্শ আমরা ধারণ করি। তবে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই আদর্শকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা হয়েছিল। এমনকি যে জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে লাখো শহীদ বুকের রক্ত দিয়েছে সেই সেøাগানও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে জাতির পিতা যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন তাকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে যে নির্দেশ জাতির পিতা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে মান্য করেছিল এবং সেভাবেই যুদ্ধ করে বিজয় লাভ করেছিল।

ঠিক পরাজয়ের আগে ওই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করে। ১০ ডিসেম্বর ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিনকে তারা তুলে নিয়ে যায়। এমন বহুজনকে তুলে নিয়ে ১০ ডিসেম্বর থেকে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে এই দেশ যেন সামনে চলতে না পারে সেই কথা মাথায় রেখেই এই ঘটনা তারা ঘটায়।’
গত ১০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সেই ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররা আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে চায়। তারা গণতান্ত্রিক ধারা পছন্দ করে না। আজকে গণতান্ত্রিক ধারা আছে বলেই বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে। দীর্ঘদিন গণতন্ত্র আছে বলেই এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’
মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগ আমাদের প্রেরণার উৎস। এই অনুপ্রেরণা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার বাতিঘর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা চাই একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে চিরতরে নিপাত যাক। বিনির্মাণ হোক শিক্ষা, গবেষণা ও আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিতে উন্নত এক স্মার্ট অদম্য বাংলাদেশ।

লেখক : অধ্যাপক; বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন

×