ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপে ঘটন-অঘটন

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৪ ডিসেম্বর ২০২২

বিশ্বকাপে ঘটন-অঘটন

.

দুু’হাজার বাইশ সালের ফুটবলের বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে কাতারে। বিশ্বকাপের উন্মাদনা বিশ্বকে কতটুকু কাঁপিয়ে তুলল জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে এর উত্তাপ রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। আবেগ উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে মারামারি হানাহানিসহ অমূল্য জীবনহানির ঘটনাও ঘটেছে। প্রিয় দলের পরাজয়ে হার্ট অ্যাটাকে একজনের মৃত্যুও হয়েছে। এক যুবক বিদ্যুতের খুঁটিতে আর্জেন্টিনার ফ্লাগ টাঙাতে গিয়ে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এ খবর আর্জেন্টিনার মেসির দল, সে দেশের জনগণ বা সরকার কেউ রাখে না। কেন মায়ের বুক খালি হলো। কেন অসহায় পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ- এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না। সেই পরিবারের ভেতরে বাইরে শুধুই হাহাকার। কিন্তু কেন? উত্তর মেলে না।

মিথ্যে, অর্থহীন আবেগের কাছে শুধুই জীবনের পরাজয় বৈ অন্য কিছুই না। তারপর সৌদি আরবের কাছে এক কালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মেসির দলের পরাজয় আবারও কেড়ে নিল তাজা প্রাণ। এসব অর্থহীন, যুক্তিহীন মৃত্যুগুলোর জন্যই কাউকে তো দায়ী করা যায় না। না ব্রাজিল, না আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের। নিয়ন্ত্রণহীন আবেগই বোধহয় এর জন্য দায়ী।
যাকগে সে কথা। ফুটবল জগতে সেই ম্যারাডোনার যুগ থেকেই একটা বিষয় ভীষণভাবে প্রচার পেল যে, ফুটবল মানেই বুঝি আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। এর বাইরে অন্য দলগুলো যেন ধর্তব্যের বাইরে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ফুটবল দলগুলো খেলতে হয়, তাই খেলছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে হাসি-কান্না-আবেগ-উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা এই দুটি দলকে ঘিরেই। সারাবিশ্বের অন্য দলগুলোর খেলা কি একেবারেই হিসেবের বাইরে। কেন? বাকি দলগুলোও তো বাছাইপর্ব উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করছে। তাহলে এ ধরনের অবহেলা কেন? আর অবহেলা, তাচ্ছিল্য নয়।
বদলে গেছে পৃথিবী। বিশ্বকাপ বিজয়ী আর্জেন্টিনা হেরে গেল অখ্যাত সৌদি দলের কাছে। জার্মানি বধ করল জাপানÑ এমনটি তো ঘটতেই পারে। এত দুঃখ কেন? শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচার করা হলো আর্জেন্টিনা সৌদি আরবের কাছে হেরে যাওয়া নাকি ‘অঘটন’। যদি তাই হয় তাহলে তো জার্মানির জাপানের কাছে হেরে যাওয়াও ‘অঘটন’। প্রশ্ন হলো- সৌদি আরবের ফুটবল দলের বিজয় কেন ‘অঘটন’ হতে যাবে? জাপানের কাছে জার্মানির পরাজয় কেন হবে অঘটন। সৌদি আরব বা জাপানের দল তো ফুটবল মাঠে বীরের মতো লড়াই করেই বিজয়ী হয়েছে। আর্জেন্টিনা কি যুগ যুগ ধরে ফুটবলের মাঠে রাজত্ব করেই যাবে!
বিশ্ব আসরে বিশ্বকাপ জয়ের অধিকার কী অন্য কারও থাকতে নেই! যদি সে অধিকার সবারই থেকে থাকে, তাহলে সৌদি আরব বা জাপান বা অন্য কোনো দেশের ফুটবল দল যদি কৌশলী খেলা খেলে, আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল বা অন্য কোনো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে বিশ^কাপ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়, তাহলে সেটাকে বিশ্ব মিডিয়া ‘অঘটন’ বলে উদীয়মান ফুটবলারদের ছোট বা তাদের বিজয়কে আকস্মিক কিছু বলে তাদের শক্তিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করার কোনো যুক্তি নেই। এটা অনেকটা পক্ষপাতিত্বেরই শামিল। বাংলাদেশের মেয়েরা সাম্প্রতিককালে সাফ গেমসে ভারত-পাকিস্তানসহ ‘সাফ’এর সকল সদস্যকে হারিয়ে ‘সাফ’ চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় নিয়ে দেশে ফিরেছে। এ বিজয়কে কি কেউ ‘অঘটন’ বলতে পারে। আসলে এগুলো ঘটনা বা ঘটন; ‘অঘটন’ বলা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না।

এ তো গেল খেলার মাঠের ঘটন-অঘটন। বিশ্বের রাজনীতির মাঠেও এ সব কোনো বিরল ঘটনা নয়। বলি সাম্প্রতিককালের ব্রিটিশদের কথা। সেটা কিন্তু সারাবিশ্বে সারা জাগানো ঘটনা। আজকের লন্ডনের ঋষি সুনাকের কথা বলছি। সেই ব্রিটিশরা যখন ভারতের হর্তাকর্তা, তখন চট্টগ্রাম ক্লাবে ব্রিটিশরাই আসা-যাওয়া করণ্ড অন্য কোনো ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল। ক্লাবের ফটকে লেখা ছিল- ‘ডগস অ্যান্ড বেঙ্গলিজ আর নট অ্যালাউড’। আজ কি হলো? ব্রিটিশরা ভেবে দেখেছেন কি ঘটনা ঘটেছে লন্ডনে?
সেই বেঙ্গলিজরা তো ভারতেরই লোক। যে ভারতীয়দের ‘ডগস’ এর সঙ্গে সমান বিবেচনা করেছেন সেই বেঙ্গলিজ অর্থাৎ, ভারতীয় একজন ঋষি সোনাক তো ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের অধিবাসী! সেই ঋষি সুনাক বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার বাগময়না গ্রামের কুটি মিয়ার লন্ডনের রেস্টুরেন্টে অর্থাৎ, বাঙালি রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করতেন। অর্থাৎ, কাজ করতেন বাঙালির রেস্টুরেন্টে। তিনি আজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এটাকে আমরা বা সাংবাদিক ভাইয়েরা কোন্্ দৃষ্টিতে দেখবেন? এটা কি কোনো রাজনৈতিক ‘অঘটন’? আরো বলি- অবশ্যই না। এটা ঘটন বা ঘটনা। কোনো অবস্থাতেই কোনো ‘অঘটন’ নয়। ঋষি সুনাক নিজের কর্মের মাধ্যমেই এ জায়গায় এসেছেন। শুধু ঋষি সুনাকই নন, অনেক বাংলাদেশের বাঙালিই বাংলাদেশী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সম্মানিত সদস্য। এগুলোও বিশ্বে সারা জাগানো ঘটনা। ঘটন, ‘অঘটন’ নয়। ‘অঘটন’ নয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসের আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়াটা। এটাও যোগ্যতা আর কর্মের ফল।
একই চিন্তায় আমরা যদি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে কথা বলি, তাহলে আমরা কি ইতিহাস পাই। এ ইতিহাস কারও অজানা থাকার কথা নয়। তবু ছিল বলছি- আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পৃথিবী বলতে গেলে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতাকামী সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পাশে সেদিন দাঁড়িয়েছিল ভারত-রাশিয়াসহ গুটিকয়েক দেশ। অপরদিকে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক তথা বর্বর পাক সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে অর্থ, অস্ত্রসহ সকল প্রকার সাহায্য নিয়ে এগিয়েছে আমেরিকা, চীনসহ বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশ। ওদের সমর্থনে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ভুট্টো-ইয়াহিয়া সরকার আর সে দেশের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা ঘরে বসে থাকে নাই।

সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ভারত-রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাস যুদ্ধের পর ৯৩ হাজার পাকি সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছে। কি লজ্জা কি লজ্জা! কেউ যদি বলে বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিদের গোহারা হারের বিষয়টি কোনো ঘটনাই না, ‘অঘটন’- তখন চরম সত্য ঘটনাকেই কি অস্বীকার করা হলো না? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বিশ্ব রাজনীতির মাঠে একটি বাস্তব ঘটনা। কোনো অবস্থাতেই ‘অঘটন’ নয়। হতে পারে না।
এমনি অবস্থায় বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পরাজয় হলেই সেটা হবে ‘অঘটন’ আর ওরা জিতলেই হবে ‘ঘটনা’- এমন ভাবনা বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারের আগে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও একটু ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করি। এ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি ভজন গানের দুটি লাইন খুব প্রাসঙ্গিক- চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। আজিকে যে রাজাধিরাজ। কাল সে ভিক্ষা চায়।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক ব্যাংকার

 

 

 

×