ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুফিয়া কামাল ও তার রাজনৈতিক দর্শন

কাজী সুফিয়া আখ্তার

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ২৬ নভেম্বর ২০২২

সুফিয়া কামাল ও তার রাজনৈতিক দর্শন

সুফিয়া কামাল

সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, সামাজিক আন্দোলনে পুরোধা ব্যক্তিত্ব রূপে ছিলেন সম্মুখ সারিতে। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আজীবন এদেশের সব মানুষের সম্মান, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করেছেন অকুণ্ঠিত চিত্তে, বলিষ্ঠ পদক্ষেপে। কিন্তু তিনি কখনো কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও তিনি ছিলেন না।

রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হওয়ার কোনো অভিলাষ তার ছিল না। তার রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল প্রচলিত রাজনীতি থেকে ভিন্ন। মানুষ মূলতঃ মানুষ। সকল শ্রেণি ও স্তরের মানুষের বাঁচার অধিকার, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের দাবি তার চিন্তা ও কর্মে ছিল সর্বাগ্রে। তার কবিতা ও সংগ্রামমুখর যাপিত জীবনে সেই পরিচয়- চিহ্ন বিধৃত হয়ে আছে। তার ধানম-ির বত্রিশ নম্বর রোডের ‘সাঁঝের মায়া’ বাড়ির প্রবেশদ্বার সকলের জন্য খোলা ছিল। কিন্তু কোনো রাজাকার বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো ব্যক্তির ঐ বাড়িতে প্রবেশের অধিকার ছিল না।

সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা প্রবহমান রাখতে বারে বারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দৃঢ় ভাবে প্রত্যাশা করতেন, যাতে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজের অবস্থান তৈরি করে দেশ ও দশের উন্নয়নে আরো ফলপ্রসূ, কার্যকর ভূমিকা এবং অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এ-কারণে যে-নারীরা সাংগঠনিক বা দলীয় রাজনীতির মূলধারায় ছিলেন, তাদেরকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উৎসাহিত করতেন। বলতেন, হারজিৎ তো থাকবেই।

পুরুষ অধ্যুষিত রাজনীতির ক্ষেত্রে এই নারীদের নির্বাচনে জিতে আসা এবং মূল রাজনীতিতে স্থান করে নেওয়ার লড়াই যে কতটা কঠিন, তা তিনি গভীর ভাবেই উপলব্ধি করতেন। ঘর-সংসার সামলিয়ে, সন্তান মানুষ করে, রাজনীতির মাঠে সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকা কত শ্রমসাধ্য, তা তিনি গভীরভাবে অনুভব করতে সক্ষম ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল দুর্গম এই পথ পাড়ি দিয়ে একদিন অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী জাতীয় এবং স্থানীয় রাজনীতিতে সমতাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হবে এবং সেদিন নারী ও শিশুদের এবং নিম্নবর্গের মানুষের খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা ও বিনোদনের খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে। মানুষে মানুষে বৈষম্য হ্রাস পাবে। মানুষ স্বমর্যাদায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হবে। রাষ্ট্রের আচরণও হবে পক্ষপাতহীন।
সুফিয়া কামালের এই বিশ্বাস তাকে ভিতর থেকে শক্তি জুগিয়েছে। আজীবন তিনি সমতাপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য আনন্দময় নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, বাঙালীর সাহিত্য ও সংস্কৃতি কোন ভাবেই যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, সে-লক্ষ্যে সমাজ শক্তি জাগরণের বহুমুখী কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। জাতির দুর্দিনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের সংকটে জাতির অভিভাবক রূপে সংকট উত্তরণে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের সময় অনেক ছাত্র নেতাদের প্রতি তৎকালীন সরকার হুলিয়া জারি করেছিল।

সুফিয়া কামাল তাদের নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বিভিন্ন সজ্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এই দুরূহ কাজে সেই সময়ে তাকে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন নারী আন্দোলনের আরেক নেত্রী আশালতা সেন। নারী, শিশু ও সাহিত্য-সংস্কৃতির স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ও আজীবন সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৪ সালে সরকারি উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা, খুলনা এবং উত্তরবঙ্গের কয়েকটি স্থানে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারী সমাজ সেদিন দাঙ্গা প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। একই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দাঙ্গা বিরোধী মিছিল বের করা হলে সুফিয়া কামাল ঐ মিছিলেও নারীদের নিয়ে যোগ দেন। কলকাতা থাকাকালীন দাঙ্গা প্রতিরোধের কাজ করার সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। সেই পরিচয় ভাই-বোনে রূপ নেয়।
জাতির পিতা তাকে বড় বোনের মতো শ্রদ্ধা করতেন। সুফিয়া কামাল তাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। স্নেহ যেমন করতেন, তেমন সমীহও করতেন। বিভিন্ন সময়ে দেশের অবস্থা নিয়ে আলাপ করেছেন। ধানম-ির একই রোডে দুটি সুন্দর বাড়িতে তারা দীর্ঘবছর কাছাকাছি বাস করেছেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের কারণে দুই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিক বন্ধন গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর পুত্র-কন্যারা তাকে ‘ফুপু’ বলে ডাকতেন। দুই ক্ষেত্রের এই দুই নেতা-নেত্রীর সখ্যতা সর্বজনবিদিত।

সুফিয়া কামালের লেখা ‘একাত্তরের ডায়েরি’র অনেক পৃষ্ঠায় তিনি যেন ভালো থাকেন; আল্লাহ যেন তাঁকে ভালো রাখেন- এই প্রার্থনার কথা লিখেছেন। বয়সে ছোট হলেও সুফিয়া কামাল বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, দেশের ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর স্বার্থত্যাগ, বছরের পর বছর কারাবরণ, রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর সততা দর্শনে তাঁকে স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে দেখতেন।
তিনি ভাষা আন্দোলনে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, ১৯৬৯ সালে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার ছিলেন ও মুক্তিযুদ্ধে সপরিবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার দাবি করেছেন সকলকে সঙ্গে নিয়ে। অকুতোভয় এই মহীয়সী নারী জীবনের ঝুঁকি আছে জেনে কখনো পিছ পা হননি। এগুলো সবই রাজনীতির বিষয়।
১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন এবং সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে এদেশের নারী সমাজ স্মারকলিপি প্রদান করে। সুফিয়া কামাল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুটি কবিতা লিখেছেন। একটি ‘মুজিবের জন্মদিনে’ (মোর যাদুদের সমাধি ‘পরে কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত) ও অন্যটি ‘মুজিব মৃত্যুঞ্জয়ী’ (অগ্রন্থিত কবিতা)। তিনি ‘মুজিবের জন্মদিনে’ কবিতায় মহান নেতার জন্মক্ষণকে এককভাবে তাঁর নয় বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এদেশের মানুষ তাঁর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নবজীবন লাভ করেছে। তিনি লিখেছেন-
‘তব জন্মক্ষণ
একক তোমার নহে। নিপীড়িত লক্ষ জনগণ
নবজন্ম লভি চেতনার
তোমারে লভিয়া কাছে হয়েছে দুর্বার।’
কবি তার কবিতায় যথার্থই বলেছেন, সেদিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন নিরস্ত্র জনতার নেতা। কিন্তু চারদিকে সংগ্রামী, সাহসী নির্ভীক এই অগ্রনায়কের জয়ধ্বনিতে ‘পীড়ক শাসক তাই শঙ্কিত হৃদয়ে কাঁপে ত্রাসে।’ তিনি তার স্বার্থহীন চারিত্রিক দৃঢ়তা দর্শনে তাঁকে আশীর্বাদ করে লিখেছেন-
‘লোভ-স্বার্থ-হিংসাহীন একনিষ্ঠ বীর!
দাঁড়ায়েছে উঁচু করি শির।
সে শিরে বর্ষুক অহর্নিশ
বিধাতার মঙ্গল আশীষ!
শতায়ু হইয়ো তুমি, কেটে যাক্ শঙ্কা ও সংশয়
এ মাটির সুসন্তান হোক্ তব জয়!’
১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ তিনি এই কবিতাটি লিখেছিলেন। তিনি ‘শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে’, ‘সাকো ও ভেনজেটিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি’, ‘ম্যান্ডেলা’র মতো রাষ্ট্রনায়কদের ও প্রথিতযশাদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন পরম আন্তরিকতায়, গভীর শ্রদ্ধায়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন গভীর মমতায়- ‘অমর শহীদ প্রাণ মহা মহীয়ান!’ কিংবা ‘ওরে দামালেরা! ওরে দুলালেরা! বাংলা মায়ের আসন আজ/ উজ্জ্বল করি বিশ্ব মাঝ / পাতিলি আপন বুকের রক্ত চুণিতে করিয়া লালে লাল,/ যুগে যুগান্তে সে মহাকাল / সম্ভ্রম ভরে হেরিবে দাঁড়ায়ে মহাবিশ্বের এ বিস্ময়।/ মানিকেরা! তোরা মৃত্যুঞ্জয়!’ (মোর যাদুদের সমাধি’ পরে)। জাতির পিতাকে নিয়ে লেখা ‘মুজিব মৃত্যুঞ্জয়ী’ কবিতায়ও তিনি উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন-
‘কোটি কণ্ঠের ধ্বনিতে শোনালে জয় বাংলা- স্বাধীন দেশ
এ মাটির প্রাণ, এ মাটির শোভা, নাহিক তাহার কভুও শেষ।
তাই তো তোমার সারা জীবনের
ঐ সে প্রাণের নাহিক ক্ষয়
মানুষের হাতে স্বজনের হাতে
মরিয়া হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়।’
 
ঢাকা, জুলাই, ১৯৯১
তিনি সবসময়ই বঙ্গবন্ধুর ইঙ্গিত করে বলতেন, ‘পঁচাত্তরের পরে আমি আর কোন রাজনীতিবিদ দেখি না। রাষ্ট্রনায়ক দেখি নাই।’ ১৯৮৮ সালে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব  করেছেন। কিন্তু তিনি কখনো আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি।
লেখক : নারী অধিকার কর্মী

×