গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ ডা. মিলন

১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হন। এই শোকাবহ ঘটনার স্মরণে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর শহীদ ডা. মিলন দিবস পালিত হয়ে আসছে। ডা. মিলনের মধ্য দিয়ে তখনকার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পতন ঘটে এরশাদ সরকারের। হাজারো সংগ্রাম, অসংখ্য আত্মত্যাগ ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় ঐতিহাসিক সংগঠন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।

চিকিৎসক ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুমূর্ষু মানুষের সেবায় সদাব্যস্ত এ সংগঠনের সদস্যরা। ১৯৯০ সাল ঢাকার রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এসেছিল সকল মতের, পেশার মানুষ। লক্ষ্য ছিল একটাইÑ স্বৈরশাসকের পতন, গণতন্ত্রের উত্তরণ। তাই ঢাকা শহর সে সময় পরিণত হয়েছিল মিছিলের মহানগরীতে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে চিকিৎসক সমাজ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে অন্য সকল পেশাজীবীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে। এলো ২৭ নভেম্বর ১৯৯০। সারাদেশে স্বৈরাচার সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে।

বিএমএ’র নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারাদেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চলছিল বিএমএ আহূত চিকিৎসক সমাবেশ। এতে যোগদানের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে রিক্সাযোগে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন তৎকালীন বিএমএ’র মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও যুগ্ম-স¤পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন।
পথিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমের সময় তাদের রিক্সা লক্ষ্য করে গুলি চালায় সামরিক জান্তাবাহিনী। বুকে গুলি লেগে রিক্সা থেকে লুটিয়ে পড়েন ডা. মিলন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে রিক্সায় করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে। সেখানে জরুরি চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে। সকলকে কাঁদিয়ে তার প্রিয় মেডিক্যাল কলেজেই শহীদের বেশে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

অথচ এই কলেজেই তিনি পড়েছিলেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে, পড়িয়েছিলেন বিনয়ী শিক্ষক হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রাঞ্জল সদালাপী পরমসহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে। ডা. মিলন শহীদ হওয়ার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়। অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে সূচিত হয় প্রাথমিক বিজয়। সার্থক হয় শহীদ মিলনের আত্মদান।
শহীদ ডা. মিলন এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের নাম। ১৯৫৭ সালের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ১ম বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৮৩ সালে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মময় জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। ঢাকা মেডিক্যালে ইন্টার্নশিপ চলাকালীন তিনি ইন্টার্ন চিকিৎসক সংগঠনের আহ্বায়ক হয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
ডা. শামসুল আলম খান মিলনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮৮ সাল থেকে। তখন বিএমএ নির্বাচনে মিলন যুগ্ম-স¤পাদক ও আমি দফতর স¤পাদক পদে নির্বাচিত হই। সেই থেকে একইসঙ্গে সংগঠনের হয়ে কাজ করতাম। দুটি ভিন্ন প্যানেল থেকে আমরা নির্বাচিত হলেও বিএমএ-র কাজে এবং পেশাগত কোনো বিষয়ে আমাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। একে অপরের সহযোগী বা পরিপূরক হিসেবে পেশার জন্য অটল থেকে কাজ করেছি। চিকিৎসকদের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি, যা তার নির্বাচিত হয়ে আসা থেকেই প্রতীয়মান হয়।
১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই বিএমএ’র বিশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি ও স্বৈরশাসকের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে সকল চিকিৎসক সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন মঞ্চ থেকে নেমে আমি আর মিলন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ওই সময় বিবিসি রেডিও থেকে টেলিফোনে বিএমএ নেতাদের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই রাতে বিবিসি রেডিওতে আমার যে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়, তাতে মিলন পাশে থেকে বিভিন্ন বিষয় কথা বলতে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন।
শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ২৭তম শাহাদাত বার্ষিকীতে আমরা তার বিদেহি আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। ডা. মিলনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এ আত্মদান ছিল দেশের সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলের জন্য। তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় একজন সমাজ সচেতন মানুষ। এদেশের হাজার হাজার চিকিৎসকদের প্রতি, চিকিৎসা পেশার প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি সর্বোপরি দেশের প্রতি তার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল অপরিসীম।
মাঝে মধ্যে হোঁচট খেলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বয়স আজ সাতাশ বছর। ডা. মিলন যে চেতনা ধারণ করে, যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রাম করতে করতে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, অনেক হতাশার পর ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিন মেয়াদে দায়িত্বরত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক সরকার তার অনেকটাই বাস্তবায়ন করেছে এবং করে চলেছে। এই দিবসে প্রত্যাশা- বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার অচিরেই বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োাজিত চিকিৎসক-কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যান্য পেশা ও ক্যাডারের মধ্যে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করবে।

কর্মস্থলে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান প্রয়োজন। চিকিৎসা অবকাঠামো নির্মাণসহ স্বাস্থ্য খাতের প্রয়োজন বাজেট বৃদ্ধি, এছাড়াও চিকিৎসকদের জন্য  স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রবর্তন, স্বাস্থ্যবীমা, ঐবধষঃয ঈড়সসরংংরড়হ গঠন সময়ের দাবি। গ্রামীণ জনপদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিকট উন্নত চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য ও সম্প্রসারিত করাও আবশ্যক।

লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়