ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কিংবদন্তিতুল্য সম্পাদকের বিদায়

মোয়াজ্জেমুল হক

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ৩ অক্টোবর ২০২২

কিংবদন্তিতুল্য সম্পাদকের বিদায়

তোয়াব খান

দেশের সংবাদপত্র জগত থেকে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হলো। যবনিকাপাত ঘটল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা জগতের একটি বর্ণাঢ্য ইতিহাসের। তিনি কিংবদন্তি সম্পাদক সাংবাদিক আবদুল তোয়াব খান। নিজের নাম সংক্ষিপ্ত করে লিখতেন তোয়াব খানই। দেশে সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম আইকন তিনি। দায়িত্ব পালন করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে। মহান একুশে চেতনার মূর্ত প্রতীক তিনি। ত্রিকালদর্শী স্বপ্নিল মানুষ। বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালীর অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের কলকাতায় অস্থায়ীভাবে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক। ‘সত্য উদ্ঘাটন, সত্যের বিকাশ এবং সত্য প্রকাশ- এটাই সাংবাদিকতার শেষ কথা।

সিন্ডিকেটেড নিউজ পেশাদারিত্বের সর্বনাশ ঘটায়’-এ উক্তি তাঁরই। দুর্দান্ত সাহসিকতার সঙ্গে কেটে গেছে তাঁর সাংবাদিক জীবন। সত্য প্রকাশে ছিলেন সরব নির্ভীক। সত্য প্রকাশের জন্য জেলও খেটেছেন তিনি। রাষ্ট্রীয় একুশেসহ সম্মাননার নানা পদকে ভূষিত হয়েছেন। নির্মোহ ঋদ্ধ মানুষ ছিলেন তিনি। ইতিহাসের বড় এক সাক্ষী। বলা চলে তিনি নিজেই এক ইতিহাস। গত পহেলা অক্টোবর ৮৭ বছর বয়সে পাড়ি জমিয়েছেন অমর্ত্য।ে জীবনাবসান হলো ত্রিকালদর্শী এই সাংবাদিকের। আমিসহ এদেশের সাংবাদিকতায় জড়িত অনেকের শিক্ষাগুরু তিনি।
তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট। অনেকের মতো তিনিও গুরুগৃহে তৈরি সাংবাদিক। সাংবাদিকতাই ছিল তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। সত্য প্রকাশের ব্রত নিয়ে তিনি চলেছেন চলমান সময়ের মতো নিরবধি। মূলত ১৯৫৩ সালে সাংবাদিক কে জি মোস্তফা সম্পাদিত সাপ্তাহিক জনতার মধ্য দিয়ে তোয়াব খানের সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এদেশের আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ।

সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে দেশের সাংবাদিকতা জগত থেকে ক্লিন ইমেজের এই তারকার মহাপ্রয়াণ ঘটল। হয়ে গেলেন ওপারের বাসিন্দা। তাঁর কর্ম দীর্ঘ সাড়ে ৫ যুগেরও বেশি সময়জুড়ে। এদেশের সংবাদকর্মীদের কাছে তিনি থাকবেন দেদীপ্যমান, চিরভাস্বর, রূপকথার এক নায়কের মতই। দেশের মিডিয়া জগতের সদস্যদের স্মৃতির আয়নায় তোয়াব খান নামটি আগামী দিনগুলোতে স্মরণ হতেই থাকবে। এ বঙ্গের সাংবাদিকতায় এক প্রবাদপুরুষ তিনি। মহাপ্রস্থানকে আলিঙ্গন করে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন।
নীতির প্রশ্নে আপোসহীন বর্ষীয়ান এই সাংবাদিকের মৃত্যু দেশের মিডিয়া জগতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় তিন দশক তিনি দেশের প্রথম চার রঙা ও একযোগে ঢাকাসহ দেশের ৫ বিভাগীয় শহর থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নতুনত্বের স্পর্শ দিয়ে মিডিয়া জগতকে বহু ধাপ এগিয়ে দিয়ে গেছেন। সাংবাদিকতা পেশাকে উপভোগ করেছেন অনাবিল আনন্দে। ঝুঁকি নিয়েছেন প্রতিনিয়ত। রগকাটা হায়েনাদের, কাফনের কাপড় প্রেরণকারীদের, স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মৌলবাদী ও জঙ্গীপনায় জড়িতসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির বিরোধিতাকারীদের রক্তচক্ষুকে পরোয়া করেননি কখনও। এক নীতি, এক আদর্শে অটল থেকে কলম চালিয়েছেন। ঘটিয়েছেন স্ফুলিঙ্গের মতো উদগিরণ । দৈনিক জনকণ্ঠের উষালগ্ন থেকেই তাক লাগিয়ে গেছেন প্রায় তিন দশক।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় স্থাপিত অস্থায়ী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ‘পিন্ডির প্রলাপ’ নামে ধারাভাষ্য প্রচার করে বাংলার অযুত-নিযুত যোদ্ধাদের মনোবলকে এগিয়ে নিয়েছেন। নিজে লিখতেন, নিজে পড়তেন- গোয়েবলসের প্রেতাত্মা, গোমর ফাঁক, বুমেরাং, ইয়াহিয়ার ভিক্ষার থলে, ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে, নয়া দাওয়াই, মুসিবতের শেষ নেইসহ অসংখ্য শিরোনামের আকর্ষণীয় সব কথিকা।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী সময়ে ফতোয়াবাজ, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁর চিন্তাচেতনা, রিপোর্ট এবং নানামুখী লেখা প্রকাশে কলাকুশলতার বহুমাত্রিকতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসীদের কাছে যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন। কাজে, চলনে-বলনে কথাবার্তাসহ সবদিক দিয়ে তাঁর স্মার্টনেন্স ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে দেশের সংবাদপত্র জগতে বিরাট একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটল। তাঁর রেখে যাওয়া কর্মজীবন ইতিহাস হয়ে থাকবে। তাঁর কাছ থেকে হাতে কলমে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা কাজ শেখার সুযোগ পেয়েছেন এবং প্রতিভার নির্যাস লাভ করেছেন, তাদের কাছে তিনি গুরুতুল্য হলেও ‘তোয়াব ভাই’ নামেই সম্বোধিত হতেন বেশি। এ সম্বোধন তিনি আপনভাবেই গ্রহণ করে নিতেন।
নিত্যদিনের সাংবাদিকতার কাজে তিনি সহকর্মীদের কাছে ছিলেন রীতিমতো সমীহের। কী রিপোর্টিং, কী সম্পাদকীয়, কী সংবাদ পরিবেশনা সকল ক্ষেত্রেই তাঁর পরামর্শ ছিল নিয়মিত। সহকর্মীদের মাঝে চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন সর্বদা। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন। অপশাসন ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছিলেন আপোসহীন। বৈরী কোন পরিস্থিতি তাঁকে তাঁর আরাধ্য লক্ষ্য থেকে কখনও টলাতে পারেনি।
জীবন ও জগতকে তিনি দেখেছিলেন ভিন্ন আঙ্গিকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র।

এক পর্যায়ে চলে যান বাম রাজনীতিতে। তিনি ইতিহাসের নামমাত্র দর্শক ছিলেন না। নিজেই তো ইতিহাস! স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সংগ্রামে এবং অভ্যুদয় পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন। সাংবাদিকতাকে গতানুগতিক ধারা থেকে নতুন ধারার তোরণে প্রবেশ করান তিনি। জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটাতে তাঁর প্রয়াস ছিল অবিরাম। নিরহঙ্কারী ও প্রচারবিমুখÑ এ দুটি ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান দিক। ছিলেন কাজ পাগল। তাঁর ছিল এক্সরে আই। প্রয়াত আরেক কিংবদন্তি অমর একুশের সেই হৃদয় আকর্ষী গানের রচয়িতা, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। দুজনেই ত্রিকালদর্শী।
জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তাঁর সঙ্গে প্রায় ২৮ বছর কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। জনকণ্ঠের চট্টগ্রাম অফিস আমার কর্মস্থল। তিনি ঢাকায় সদর দফতরে। সেখান থেকে নিয়মিত তদারকি। রিপোর্ট নিয়ে নানামুখী নির্দেশনা দিয়ে আমার মতো তাঁর শিষ্যদের অভিজ্ঞতার ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছেন। রিপোর্টকে সমৃদ্ধ করতে তাঁর সহযোগিতা আমার জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে। রিপোর্ট নিয়ে ইশারাই যথেষ্ট।

দেশী-বিদেশী রিপোর্টারদের রিপোর্ট, সহকারী সম্পাদক, নিয়মিত ও অতিথি কলাম লেখকদের লেখা লাইন বাই লাইন পড়তেন। ঠিক মনে হলে ছাপতেন। এক্সক্লুসিভ ও অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছাপা হলে খবর নিতেন। জানতে চাইতেন কোন রি-এ্যাকশন আছে কিনা! ফলো-আপ তো করতেই হতো। অনুরূপভাবে নিত্যদিনের ছবি প্রকাশ নিয়েও তাঁর ছিল ভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ছবি, নিজস্ব ফটোগ্রাফারদের ছবির পর ছবির রীতিমত স্তূপ। পছন্দ করানো হতো মুশকিল । ‘এসব কিছুই হয়নি’- রিপোর্ট ও ছবি সিলেকশনে এমন বক্তব্য সিনিয়র সহকর্মীদের প্রায়ই শুনতে হতো।
সহজে অফ-ডে নিতে দিতেন না। বলতেন, সাংবাদিকদের আবার কিসের অফ-ডে- এভাবে ২৮ বছর অতিবাহিত হয়েছে তাঁর সঙ্গে। তাঁর ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝতে হয়েছে প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি কোন্ আঙ্গিকে রিপোর্ট চাচ্ছেন। তাঁর চাওয়া-পাওয়া আঙ্গিক পূর্ণ করতে পারলেই শান্তি। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য রিপোর্ট করেছি, যা প্রকাশ হয়েছে। লিড আইটেম হয়েছে অজস্র। এ জাতীয় রিপোর্টের পর ফলোআপ করা ছিল অনেকটা বাধ্যতামূলক। আবার রিপোর্ট নিয়ে ঘটনার নেপথ্য কাহিনী তুলে ধরাও ছিল শিরোধার্য। ফিচার স্টাইলের নিউজ তিনি পছন্দ করতেন বেশি।

সাহিত্যের মিশেলে হলে তো কথাই নেই। ফলে তাঁর সঙ্গে জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন কাগজে যারা কাজ করেছেন, তারা বুঝতেন রিপোর্ট নিয়ে তাঁর প্রত্যাশা কি থাকত। এ প্রত্যাশা পূরণ করতেই রিপোর্টারদের ঘাম ঝরত। সন্ধ্যার আগেই চাই রিপোর্ট। কোন ধরনের অজুহাত তাঁকে দেয়া যেত না। রিপোর্ট দিলেই শান্তি। উপদেষ্টা সম্পাদকের পদে থেকে তিনি হাতে কলমে জনকণ্ঠের প্রতিটি বিভাগ পরিচালনা করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। দেশের মিডিয়া জগতে তিনি অমর অক্ষয়।
সংবাদ বিজ্ঞানী তোয়াব খান জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয়সহ বিভিন্ন সম্মাননা প্রাপ্তিতে দুর্লভ সৌভাগ্যবানদের একজন। তিনি রাষ্ট্রীয় একুশে পদক ছাড়াও বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আজীবন সম্মাননা, প্রয়াত সাংবাদিক ‘এবিএম মূসা’ আজীবন সম্মাননা, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে স্বর্ণপদক, হুজ হু পদক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননাসহ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ ও জাতি হারালো এক অমূল্য সম্পদ।

লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, জনকণ্ঠ

×