ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মদিনে বঙ্গমাতার আগমন

মোহিত কামাল

প্রকাশিত: ০০:২৯, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

জন্মদিনে বঙ্গমাতার আগমন

জন্মদিনে বঙ্গমাতার আগমন

আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। আকাশটা অনেক বড়! দিগন্তের সীমানাজুড়ে আকাশ নেমে গেছে বৃত্তাকারে। আকাশের বুকে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘ। সারিবদ্ধ একঝাঁক পরিযায়ী পাখিও উড়ে যাচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। সকালের কোমল রোদ পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে মেঘপুঞ্জের গায়ে, পাখিদের ডানায়।
কী সুন্দর! কী অপূর্ব! কী পবিত্র!
হঠাৎ মনে হলো মাটি থেকে আকাশে উঠে বসে আছে আলোময় এক হিমালয় চূড়া। তার ওপর বসে আছেন অদৃশ্য এক আলো-মানব!
কিছু কি বলছেন, বলতে চাচ্ছেন এই আলোর মানুষ?
কান খাড়া করে রইলেন শোনার জন্য।
‘বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের জন্য তোমাকে অভিনন্দন।’
‘আমি তো কোন স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কাজ করি না। আমি জনগণকে ভালবাসি। আমার দেশকে ভালবাসি। দেশের উন্নয়নের জন্য, জনগণের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
‘তোমার এই মহানব্রতই তোমাকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে, বিশ্বজুড়ে তোমার প্রশংসা আর গুণকীর্তন চলছে!’
‘আমি গুণকীর্তন চাই না। প্রশংসা চাই না। সমালোচনা আমাকে কাবু করতে পারে না। সমালোচনাও আমি বরণ করতে জানি এবং তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। আমার দেশের মানুষ স্বস্তিতে দুমুঠো ভাত খেতে পারলে আমি সুখী।’
আকাশের ঠিকানায় হিমালয় হয়ে বসে থাকা আলোর মানুষ আরও আলো ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। রশ্মি নেমে আসতে লাগল পৃথিবীর বুকে। ছুঁয়ে গেল বাংলাদেশের মাটি, গাছগাছালি, মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর চোখ।
নড়ে উঠলেন তিনি! এই আলোর স্পর্শ তো তাঁর চেনা! এ আলোর গন্ধও! এ আলোর আদরও তাঁর চেনা!
স্মৃতির ঘরে ঘণ্টাধ্বনী বেজে উঠল। বুকের ভেতর তোলপাড় করে উঠল। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে মা-বাবাসহ তাঁর পুরো পরিবার, হত্যা করেছে অবুঝ ছোট ভাইকেও। বিদেশে থাকার জন্য বেঁচে গেছেন তিনি আর তাঁর বোন। বিদেশের মাটিতে বসে অবিশ্বাস্য ঘটনাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে পাতালে পড়ে গিয়েছিলেন দুই বোন। প্রবাসে কেটেছে দুঃসহ দিন।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে আবার ফিরে তাকালেন আকাশের দিকে। পদে পদে মৃত্যুর ফাঁদ, চোরাগোপ্তা হামলা, প্রকাশ্যে বৃষ্টির মতো গুলি, বোমা বিস্ফোরণ কিংবা গ্রেনেড হামলার অনিবার্য মৃত্যু থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া তিনি হাল ধরে আছেন নৌকার। ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ উত্তাল সাগরে এগিয়ে চলেছেন অসীম সাহস, মরণজয়ী প্রতিজ্ঞা, প্রজ্ঞা আর ক্লান্তিহীন কাজ করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। পিতার মতোই তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালী জাতির মুক্তির প্রতীক, বিশ্বনেতা।
‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছ। একুশ শতকের ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বনেতাদের মধ্যে শীর্ষ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছ তুমি। সামনে আরও এগিয়ে যাবে, বিশ্বাস আমার। আকাশের ঠিকানা থেকে জানাই তোমাকে রৌদ্রোজ্জ্বল অভিনন্দন, অনন্ত ভালবাসা, আদর আর শুভকামনা।’
‘এসব অভিধার জন্য আমার কোন লোভ নেই। তবে তোমার দোয়া, ভালবাসা ও আদর আমার পাথেয়। মৃত্যুঝুঁঁকি নিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি নির্ভয়ে। একের পর এক ষড়যন্ত্রকারীদের নীল নকশা বানচাল করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিডিআর বিদ্রোহের আড়ালে নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমাকে হত্যা ও উৎখাতের দৃশ্যমান ষড়যন্ত্রের কথা আমি ভুলিনি। দেশবাসীও ভোলেনি। এখনও মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত ক্ষমতালিপ্সু অন্ধকারের শক্তির সন্ত্রাসী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছি।

মানবাধিকার রক্ষার জন্য যারা হাহাকার করেন তাঁরা তখন এগিয়ে না-এলেও স্বচ্ছ আইনী প্রক্রিয়া মেনে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছি। আইনগতভাবে সাজাপ্রাপ্ত ধৃত খুনীদের অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বিচারের রায় কার্যকর করেছি। এই বিচার করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁঁকিকে পরোয়া করিনি। এছাড়াও ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতিহারে অঙ্গীকার করা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতির কথাও ভুলিনি। তাদেরও বিচার করেছি। আইনী-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লড়ে যাচ্ছি। আমি মনে করি এসবও আমার বড় দায়িত্ব।’
দীপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে হিমালয় চূড়ায় বসে থাকা আলো-মানবের অদৃশ্য দেহগলে ঝরতে লাগল নরম তুলার মতো শুভ্র মেঘকণা। এর স্পর্শ পেয়ে প্রশান্তি জেগে উঠল তাঁর মনে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলেন ফেলে আসা জীবনের মধুময় স্মৃতি।
আকস্মিক মনে হলো আদরের ছোট ভাইটি সাইকেল ফেলে ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, ‘হাসুপা, আমাদের কেউ মারতে পারেনি। আমরা তো বেঁচে আছি তোমার মধ্যে, ছোট আপুর মধ্যে, ভাগিনা-ভাগ্নিদের মধ্যে; আমাদের দেশের জনগণের মনের মণিকোঠায়।’
আকাশ কেঁদে উঠল। মাটিও কেঁপে কেঁপে কান্নার রোল ছড়িয়ে দিল। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। উড়ান পাখিরদলও কান্নার রোল ছড়িয়ে উড়ে যেতে লাগল। বাতাসেও কান্নার ঢেউ উড়ে বেড়াতে লাগল। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখ থেকে ঝরতে লাগল লোনা জল।
‘কিরে হাসু, কাঁদছিস কেন? আমরা তো ওপারে ভালই আছি। ফুলেফুলে সৌরভে-আনন্দে আমরা ভালই আছি আর দেখছি তোর এগিয়ে যাওয়া, তোর সংগ্রামী চেতনা, তোর সাহস, তোর কাজের একাগ্রতা, সততা সব দেখতে পাচ্ছি।’
‘কে? কে? কে কথা বলছেন? কার কথা শুনছি?’
‘আমি বঙ্গমাতা। চোখ মেলে দেখ, আমি কেবলই তোর মা নই, কেবলই তোর বাবার ছায়াসঙ্গী নই, কেবলই তাঁর জীবনসঙ্গী নই, আমি বাংলাদেশের মা, বাংলাদেশের মানুষের মা, বঙ্গমাতাই।’
‘মা, মাগো! তোমরা আমাকে দেখতে পাচ্ছ, মা?’
‘সবই দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দোয়া ছড়িয়ে দিচ্ছি তোর জন্য। ছায়া হয়ে আছি তোর মাথার ওপর আকাশজুড়ে, আকাশে-বাতাসে!’
‘মা, মাগো দোয়া কর, আমি যেন বাবার মর্যাদা রাখতে পারি, তোমার মর্যাদা রাখতে পারি।’
‘বাবার মর্যাদা কি রাখিসনি? বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া নিজস্ব অর্থে বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরিসনি? কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা মহানগরে উড়াল রেল, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ, দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তববাদ হলে দেশের উন্নয়ন কোন স্তরে যাবে তা অনুমান করে আমি খুশি, মহাখুশি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা মহাকাশযোগে প্রবেশ করেছি। এসব কি জাতিকে দূরদর্শী প্রজ্ঞাবান রাষ্ট্রনায়ক উপহার দেয়নি?’
মায়ের প্রত্যয়দীপ্ত কথা শুনে সাহস বেড়ে গেল তাঁর মনে। তবু আরও কিছু শোনার আশায় আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রাণে-মনে।
আকাশ ফুঁড়ে বাতাসের তরঙ্গ সাঁতরে ছুটে আসতে লাগল বঙ্গমাতার অনন্য শব্দতুফান, প্রশ্নঝড়:
‘বাংলাদেশকে কি উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করিসনি? মাথাপিছু আয় তিন থেকে চার ডিজিটে তুলে আনিসনি? পাশাপাশি খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনসহ সবজি, মাছ-মাংস, ফল উৎপাদনে প্রথম চার দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান প্রতিষ্ঠা করিসনি? সমুদ্রে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করিসনি?
সাহসের সঙ্গে কি অদৃশ্য শত্রু করোনার আক্রমণ মোকাবেলায় সফল হসনি? ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে মর্যাদা লাভ করিসনি? আমরা খুশি। আমাদের কন্যা আকাশ ছুঁয়েছে। আকাশ ফুঁড়ে নিশ্চয় আরও যাবে উপরে।’
মায়ের সঙ্গে আরও কথা বলার লোভ সামলাতে পারলেন না তিনি। প্রশ্ন করলেন, ‘মা, স্বার্থান্বেষীমহল তো ইতিহাস বিকৃত করে ফেলে।’
‘সে সুযোগ আর নেই। কোন মহল আর ৭ মার্চের ভাষণ উড়িয়ে দিতে পারবে না। কোনভাবেই ইতিহাস আর বিকৃত করা যাবে না। ইতোমধ্যে ভাষণটি ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, সুরক্ষার উচ্চ আসনে উঠে গেছে। তোরা দুবোন অসাধারণভাবে সুরক্ষা করেছিস তোদের বাবার জেলজীবনে লেখা ডায়েরি। তিনটি বই আকারে তা প্রকাশ করেছিস : অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন। এসব বই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনূদিত হয়েছে। হচ্ছে। অক্ষরস্রোতে কালজয়ী হয়ে গেছেন তোদের বাবা। ইতিহাস থেকে আর বিলীন হবেন না তিনি।’
মায়ের কথা শুনে বুক ভরে উঠল আনন্দে। এতসব কাজ করা হয়ে গেছে! আপন কাজের মগ্নতার ভেতরে থেকে যাপিতজীবনে তা টেরই পাননি তিনি। প্রশান্তি নিয়ে বললেন, ‘এজন্য তুমিও ইতিহাসের অংশীদার, মা। জেলখানায় বাবার হাতে যদি ডায়েরিগুলো তুলে না দিতে তাহলে আমার বাবার এই গুরুত্বপূর্ণ দলিল হাতে পেতাম না আমরা। তোমার দূরদর্শিতা আর প্রজ্ঞা আমাদের তো বটেই, বিশ্বকেও আলোকিত করেছে। তোমাকে স্যালুট, মা।’
‘আমার প্রশংসা করার দরকার নেই। স্ত্রী হিসেবে আমার যা করার দরকার ছিল আমি তাই করেছি।’
‘তুমি কেবল আদর দিয়ে আমাদের মানুষ করোনি, কেবল বাবার জেলজীবনের সময় দুঃসহ যাতনা ভোগ করোনি, কেবল গরম গরম পিঠা ভেজে কাসের থালায় তুলে খাওয়াওনি, একইসঙ্গে ইতিহাসের মহান থালায় তুমি তুলে দিয়েছ বাংলাদেশের স্বাধীনতার শেখড় সন্ধানী অক্ষরমালাও।’
প্রশংসা শুনে চুপ হয়ে গেলেন মা। কিন্তু মেয়ের মন মানে না। আরও কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মাকে খুঁচিয়ে দেয়ার জন্য তিনি আবার বললেন, ‘তুমি বলছ, অনেক ভাল কাজ করেছি আমি। কিন্তু সমালোচকরা তো ভাল কাজটা দেখে না। তারা আমাকে অমানবিক বলে দোষ ধরার চেষ্টা করে।’
‘তারা অন্ধ। তাদের চোখে আলো নেই। তারা বধির, তাদের মুখে ভাষা নেই। তাদের বুক অন্ধকারের ঢাকা, তাদের মনেও আলো নেই। তারা কি দেখেনি নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দান, অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে তুই কি মহান কাজ করেছিস? তারা কি দেখেনি ব্রিটেনভিত্তিক গণমাধ্যম চ্যানেল ফোর ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ বা ‘মানবতার জননী’ বলে ভূষিত করেছেন তোকে। দেখিনি। তারা দেখবে না।

তাদের না দেখা নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই। তুই আকাশ ছুঁয়েছিস। আমি চাই, আমাদের দরদি ও মানবিক কন্যা, বাবার মতোই তর্জনির গর্জন তুলে আকাশ ফুঁড়ে আরও উপরে যাবে, আরও আরও উপরে। আজ তোর ৭৬তম জন্মদিন, প্রিয় হাসু। এই দিনে তুই কঠিন পৃথিবীতে এসেছিলি আলো ছড়াতে। আমি চাই এ আলো ছড়িয়ে যাক বিশ্বজুড়ে।’
আদরের হাসুকে শুভেচ্ছা জানালেন বঙ্গমাতা।

×