ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দল ও দেশের কাণ্ডারি

ফরিদ হোসেন

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

দল ও দেশের কাণ্ডারি

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা মূলত পেশাগত। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি যখন ছয় বছরের নির্বাসিত বসবাস শেষে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে প্রিয় বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন আমার সাংবাদিকতার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। এর কয়েক মাস আগে ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তখনও তিনি প্রবাসে নির্বাসনে।
১৯৭৫-এর নারকীয় হত্যাকা-ের সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ শেষবর্ষের ছাত্র। এর এক বছর পর ১৯৭৬ সালে আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু অধুনালুপ্ত ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি বা ঊঘঅ’র (এনা) মাধ্যমে। আমার শরীরে তখন রাজনীতির গন্ধ প্রকট। চিন্তা-চেতনা ও মননে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- ও পরবর্তী পটপরিবর্তনের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শুরুতে দেখতে পেতাম, বার্তা কক্ষে, আমরা যারা বঙ্গবন্ধুপ্রেমী তাদের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যেত জিয়া অনুসারীদের  আস্ফালনে। কারও কারও মুখে শুনতাম জিয়াই বাংলার ভবিষ্যত।

এদের মধ্যে অনেকেই জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বলে শুধু মেনেই নেয়নি, সেটা দেশে বিদেশে প্রচারেও নেমে পড়েছে। দুর্বল আওয়ামী লীগের সভা, সমাবেশ ও কোন কর্মসূচী সম্পর্কে রিপোর্ট করার জন্য সিনিয়র কাউকে এ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হতো না। আমাদের মতো নবীনদের পাঠানো হতো। তখন বার্তা সংস্থা ছিল দুটিÑ একটি সরকার পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বা বাসস।
দ্বিতীয়টি বেসরকারী মালিকানার এনা। তখনকার বাসস থেকে আওয়ামী লীগের কোন খবর তেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হতো না। তখন শুধু জিয়া তার মন্ত্রিবর্গ ও তার দলের নেতাদের নিয়ে সকলের মাতামাতি। এমনকি ১৫ আগস্টের পর তেমন পাত্তা পেত না। বঙ্গবন্ধুর নাম, ১৫ আগস্টের রক্তপাত নিয়ে কথা বলা যেত না। বেসরকারীভাবে পরিচালিত বার্তা সংস্থা এনা ও দু’একটি পত্র-পত্রিকা ও সাপ্তাহিকী, অবশ্য সাহস করে দু’চার কথা লিখত, রিপোর্ট করত। তখন গণমাধ্যমে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, বিবাদ-বিকীর্ণ আওয়ামী লীগের তেমন ভবিষ্যত নেই।
আমার খুব খারাপ লাগত। আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি কমিউনিস্ট পার্টির একজন কর্মী হিসেবে। প্রকাশ্যে করতাম বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)। আওয়ামী লীগ না করলেও বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসি। তিনি না থাকলে যে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না তা দৃঢ়মনে বিশ্বাস করি। ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুরতার পর বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার ভালবাসা আরও গভীর হয়ে ওঠে। কেন এমন হলো? কেন স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় আমরা আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নায়ককে এমনভাবে হারালাম। সাংবাদিকতা করি বটে।

তবুও নিজেকে একজন রাজনৈতিক কর্মী বলেই মনে করি। তাই কোন সংবাদ সম্মেলন, জিয়ার কোন মন্ত্রী বা নেতার অনুষ্ঠান কভার করতে গিয়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নামে বিষোদগার শুনি, তাঁর পরিবারকে নিয়ে মিথ্যা রটনা হয়। কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নয়-মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন শুনি বা দেখি পত্রিকার পাতা থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পাকিস্তানী গণহত্যা শুরুর কালরাত উধাও হয়ে যায়। ভাসুরের নাম মুখে-আনতে মানার মতো ১৯৭১ সালের হানাদার বাহিনীর আগে থেকে ‘পাকিস্তান’ কথাটি সরকারীভাবে বাদ দেয়া হয় তখন মনে গভীর ক্ষোভ জমে। আমি ও আমার মতো যারা তখন ভাবছি, বাংলাদেশ সঠিক পথে চলছে না, তারা কেমন যেন কোণঠাসা হয়ে পড়ছি।  ক্ষতবিক্ষত আওয়ামী লীগ তখনও দুর্বল, তবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সারাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের বাতিঘর হবার চেষ্টা করছে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর পর্যায়ে আওয়ামী লীগে আনুষ্ঠানিক প্রবেশ ঘটে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনিই হয়ে ওঠেন দলটির কা-ারি। তিনি ফিরে এলেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। আর সেই ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। প্রথমে লাখো জনতার ভিড়ে দূর থেকে, পরবর্তী সময়ে আরও কাছে থেকে।
সামনা-সামনি দেখা হয় প্রত্যাবর্তনের দু’একদিন পরেই। দেশে ফিরে তার প্রথম সফর ছিল টুঙ্গিপাড়া। বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। মনে পড়ে সেদিন আমিসহ আরও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। রিপোর্টার হিসাবে। ছোটখাটো একটি লঞ্চ। সদরঘাট/সোয়ারিঘাট থেকে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা। ড. ওয়াজেদ মিয়াও সেদিন সফরসঙ্গী ছিলেন। আরও ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। যাত্রার শুরুতেই সাংবাদিকদের সঙ্গে শেখ হাসিনার পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। ড. ওয়াজেদের সঙ্গেও পরিচিত হই। পরিচয়পর্ব শেষে তিনি নেতাদের কোন একজনকে বললেন, সাংবাদিক যারা আছে তাদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। এখানে আমার একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির উল্লেখ না করে পারছি না।

টুঙ্গিপাড়ায় আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়েছিল একটি বড়সড় ঘরে। সে রাতে আমার প্রচ- মাইগ্রেনের ব্যথা। কিছুই খেতে পারছি না। যতদূর মনে পড়ে আমাদের দেখাশোনা করছিল বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম। আমার মাথাব্যথার কথাটি তার কানেও গেল।
পরে শুনেছি কথাটি শেখ হাসিনার কানেও পৌঁছেছিল। ফলাফল বাড়ির ভিতর থেকে আমার জন্য এক গ্লাস গরম দুধ পাঠানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যার এমন আতিথেয়তার ভূরি ভূরি গল্প আছে আমার মতো সাংবাদিকদের কাছে। যারা তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছেন দেশে ও বিদেশে। সাংবাদিকরা খেয়েছেন কিনা এটা নিশ্চিত হতেন। এ ব্যাপারে কোন ব্যত্যয় ঘটলে তিনি ক্ষুণœ হতেন।

আমার প্রায় পঞ্চাশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এবং এর বাইরেও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী যখন তাঁর সঙ্গে অনেক আলাপচারিতা হয়েছে। তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে কথা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বুলেটবিদীর্ণ মরদেহ সিঁড়িতে লুটিয়ে আছে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেরই খবর নেই। কেউ কেউ চলে গেছেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিতে। প্রত্যাবর্তনের পর শেষ পর্যন্ত যখন তিনি ৩২ নম্বর বাড়িতে ঢুকতে পারলেন সেখানেই তিনি থাকতেন। মনে পড়ে, সেদিনগুলোতে কোন এ্যাসাইনমেন্ট না থাকলেও কোন ফাঁকা বিকেলে চলে যেতাম ৩২ নম্বরে।

আমি প্রায়শই যেতাম ইত্তেফাকের সিনিয়র সাংবাদিক বর্তমানে সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান ভাইর সঙ্গে। কখনও বা বেবী মওদুদের (বেবী আপার) সঙ্গী হয়ে। তখন আমরা যারা আওয়ামী লীগ বিশেষ করে দলের সভানেত্রীর বিট করতাম, তারাই বেশি যেতাম। তিন/চারজনের দল। গল্প করতে করতে দুপুরের খাবার সময় হলে তিনি তাঁর সঙ্গে ছোট একটি ডাইনিং টেবিলে আমন্ত্রণ জানাতেন। খাবার তালিকায় ভর্তা, ছোট মাছ ও ডাল, ভাজি। আমরা সানন্দে যোগ দিতাম। এসব ক্ষেত্রে তিনি পুরোটাই পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। যারা বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছেন একথা শুনেছি তাদের মুখ থেকে।
১৯৮৮ সালে আমি এনা থেকে ইউএনবি (টঘই) তে যোগ দিয়েছি। বস্তুত আমরা ছিলাম নতুন এই  কম্পিউটরভিত্তিক বার্তা সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা স্টাফদের অন্যতম। ইউএনবি থেকে চলে এলাম মার্কিন বার্তা সংস্থা এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) তে। এপিতে আসার পর তাঁর সঙ্গে আগের মতো দেখা সাক্ষাত হতো না। শুধু আন্তর্জাতিক মূল্য আছে এমন খবরগুলো নিয়েই তখন নাড়াচাড়া করতাম। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণতন্ত্র উদ্ধার আন্দোলন ছিল তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা।

আছেন বেগম খালেদা জিয়া, যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচী। সংঘর্ষ, গুলি, গ্রেফতার এবং একটি পর্যায়ে ঘন ঘন সান্ধ্য আইন। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ বিদায় নিলেন। ১৯৯১ সালের ২৭ ডিসেম্বর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধানে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হলো। নির্বাচনের প্রচার অভিযানের সময় আওয়ামী লীগ ছিল তুঙ্গে। নির্বাচনে শেখ হাসিনার দলই নির্বাচিত হবে। তিনিই যে হবেন স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী প্রথম প্রধানমন্ত্রী দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের মধ্যে প্রবল ধারণা ছিল। কিন্তু জয়ী হয়েছিল বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন খালেদা জিয়া।
আওয়ামী লীগের এই হতবাক পরাজয় সম্পর্কে অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে। অনেকেই ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের অকস্মাৎ ভোল পাল্টে অংশগ্রহণ করাকে দায়ী করেছেন। শেখ হাসিনাও বিস্মিত হয়েছেন। সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ করেছেন। ক্ষণিকের সেই দুঃসময়ে তাঁর কাছে যেতাম। তাঁর ক্ষোভের কথা শুনতাম। কাদের পরামর্শে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল তাদের কথা বলতেন।
যারা নির্বাচনে যেতে বলেছিলেন, তারাই আবার মাঝপথে ভোট বর্জনের কথা বলেছিলেন। একটা ল্যাজে-গোবর অবস্থা আর কি! সেই বৈরী সময় কাটিয়ে তিনি আবার ফিরে এসেছেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ২১ বছর পর আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ফিরে পেয়েছেন। সেই ক্ষমতা আবার হারালেন ২০০১ সালে।

বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলো। এবার তার প্রত্যক্ষ মিত্র স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার, আলবদর যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পরও আমরা সাংবাদিকরা তাঁর কাছে যেতাম। তখন তিনি ধানম-ির সুধা সদনে অফিস করতেন। এই হেরে যাবার পেছনে তাঁর দলের কতিপয় নেতার ভূমিকা, দেশের সম্পদ গ্যাস রফতানির বিরুদ্ধে অবস্থান ও তদুপরি বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে দায়ী ছিল তা তিনি বলতেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণ তাঁর অলৌকিক বেঁচে যাওয়া, তাঁকে হত্যা করার জন্য ১৮ বারের অপচেষ্টা, জামায়াত,বিএনপি ও যুদ্ধাপরাধীদের ষড়যন্ত্র- সব কিছু পেরিয়ে শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী। ২০০৯ থেকে টানা তৃতীয়বারের মতো দেশের হাল ধরে আছেন। দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এসেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আজ জন্মদিনে তাঁকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। তাঁর দীর্ঘায়ু বাংলাদেশের জন্য, জনগণের জন্য, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির জন্য মঙ্গলজনক হবে।

×