ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের আন্দোলনে শেখ হাসিনার অবদান

শাহরিয়ার কবির

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

আমাদের আন্দোলনে শেখ হাসিনার অবদান

আমাদের আন্দোলনে শেখ হাসিনার অবদান

বাংলাদেশে নাগরিক আন্দোলনের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন। ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল এই অভূতপূর্ব আন্দোলন। সূচনাপর্ব থেকে নির্মূল কমিটি প্রধানত দুটি দাবির পক্ষে জনমত সংগঠিত করছে : যার একটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং অপরটি যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ।
নাগরিক আন্দোলন সাধারণভাবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটি গঠন করার সময় আমরা স্থির করেছিলাম, জামায়াতের মতো একটি নৃশংস ফ্যাসিস্ট দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী সংগঠনের সমর্থন প্রয়োজন হবে। তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন বিরোধী দলের নেতা। তখন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। দেশে ফিরেছিলেন সম্ভবত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। ইতোমধ্যে আমরা বামদের পাঁচ দলীয় জোটের সমর্থন পেয়েছি, আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটিরও সমর্থন পেয়েছি।

গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের কর্মসূচীর প্রতি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী সংগঠনের সমর্থন ও একাত্মতা প্রকাশের সংবাদ তখন প্রতিদিন খবরের কাগজে ছাপা হতো। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর জাহানারা ইমাম তাঁকে ফোন করে দেখা করতে চাইলেন। বললেন, আমাদের প্রতিনিধি দলে কবি সুফিয়া কামালও থাকবেন। শেখ হাসিনা তখন ২৯ নম্বর মিন্টো রোডে বিরোধীদলীয় নেতার সরকারী বাসভবনে থাকতেন। জাহানারা ইমাম বললেন, আমরা ২৯ নম্বরে না হলে ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি।
সুফিয়া কামাল আমাদের সঙ্গে আছেন জেনে শেখ হাসিনা বললেন, খালাম্মা কেন কষ্ট করে আমার বাসায় আসবেন। আমি তাঁর বাসায় যাব। সুফিয়া কামালকে জাহানারা ইমাম আপা ডাকতেন। আমরা সবাই খালাম্মা ডাকতাম। তিনি ৩২ নম্বর ধানম-িতে ‘সাঁঝের মায়া’য় থাকতেন। ৮ ফেব্রুয়ারি সুফিয়া কামালের বাড়িতে বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে নির্মূল কমিটির শীর্ষ নেতাদের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। জাহানারা ইমামের সঙ্গে আমাদের দলে কর্নেল (অব) জামান ও সৈয়দ হাসান ইমামও ছিলেন। শেখ হাসিনা সব শুনলেন। বললেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো বঙ্গবন্ধুর সরকারই আরম্ভ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এ বিচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিলেন- তাঁর পক্ষ থেকে যা কিছু সহযোগিতা প্রয়োজন তিনি দেবেন। তারপর বললেন, তাঁর এবং দলের পক্ষ থেকে আবদুর রাজ্জাক এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।
শেখ হাসিনার এই সমর্থন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনোবল উজ্জীবিত করেছিল। শেখ হাসিনার সঙ্গে জাহানারা ইমামের পরিচয় হয়েছিল নির্মূল কমিটি গঠনের প্রায় অর্ধযুগ আগে। ১৯৮৬ সালে জাহানারা ইমামের কালজয়ী গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রকাশের পরই আলোচনা ও প্রশংসার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। একদিন শেখ হাসিনা এই বইয়ে অটোগ্রাফের জন্য জাহানারা ইমামের বাড়িতে গিয়েছিলেন বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের নিজের বাড়িতে দেখে জাহানারা ইমাম কী পরিমাণ অভিভূত হয়েছিলেন; পরে বহুবার সে কথা তিনি আমাদের বলেছেন। শেখ হাসিনা তাঁকে খালাম্মা ডাকতেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও কবি সুফিয়া কামালের প্রতি শেখ হাসিনার দুর্বলতা ও শ্রদ্ধা নির্মূল কমিটির আন্দোলনে তাঁর সহযোগিতার ভিত নির্মাণ করেছে। সূচনাপর্বে যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দৃঢ় সমর্থন আমাদের সাহস জুগিয়েছে।
নির্মূল কমিটি গঠনের তিন সপ্তাহের ভেতর ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠনের পর ২৬ মার্চ গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের পক্ষে জনমত সংগঠনের কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ করেছিলাম, ২৬ মার্চ পর্যন্ত তাদের সকল দলীয় কর্মসূচী স্থগিত রেখে গণআদালতের কর্মসূচীর পক্ষে কাজ করার জন্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেবারই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি এক মঞ্চে একত্রিত হয়ে নাগরিক সমাজের এই অভূতপূর্ব আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল।

জাহানারা ইমামের আন্দোলন বহুধাবিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এই আন্দোলনের আগে কেউ ধারণা করতে পারেননি শেখ হাসিনা, নির্মল সেন, বদরুদ্দীন উমর কিংবা আহমদ শরীফ, কবীর চৌধুরী, গাজীউল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রায় একই ভাষায় কথা বলছেন। জাহানারা ইমাম একটি কথা তাঁর ভাষণে প্রায়ই বলতেন- ‘আমাদের অনৈক্যের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা এত শক্তিশালী হতে পেরেছে।’ ১৯৯২-এর মার্চে গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের পক্ষে সারাদেশে যখন গণআন্দোলনে উত্তাল, খালেদা জিয়ার সরকার নিরাপত্তার কথা ভেবেই গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। অপরদিকে গণআদালতের কর্মসূচীর বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।
নির্মূল কমিটি গঠনের পরপরই আমরা আমাদের দাবির সমর্থনে প্রথম দফায় ৫ লাখ গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করি। পেশাজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি দিয়ে সমর্থন করেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১০০ সংসদ সদস্যের বিবৃতি। এ বিষয়ে ‘গণআদালত ও জাহানারা ইমাম’ গ্রন্থে আমি বিস্তারিত লিখেছি। সম্ভবত ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে জাহানারা ইমাম শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আমাদের ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সই দেয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন। শেখ হাসিনা বক্তব্য পড়ে বললেন, ‘এটা আমার কাছে রেখে যান।

আমি একা কেন, অন্য সব সংসদ সদস্যের সই আমি সংগ্রহ করে দেবো।’ ৮ মার্চের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে গণআদালতের কর্মসূচীর সঙ্গে ১০০  সংসদ সদস্যের একাত্মতা ঘোষণার সংবাদ। সারাদেশের নির্মূল কমিটির ভেতর প্রচ- উৎসাহ আর উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল এই সংবাদ। সংসদ সদস্যের মূল স্বাক্ষরসহ এই ঘোষণা দেড় লাখ ছাপা হয়েছিল লিফলেট আকারে। সবার ওপরে ছিল ‘বিরোধী দলের নেতা’ শেখ হাসিনার নাম।
নির্মূল কমিটির ২৩ বছরের আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসূচী ছিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসিয়ে গোলাম আযমের বিচার। কারণ, ক্ষমতায় তখন খালেদা জিয়ার জামায়াতবান্ধব বিএনপি সরকার। গণআদালত প্রতিহত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ২৫ মার্চ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ সংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। বলা হলো, কেউ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে।
২৫ মার্চ বিকেল ৩টার দিকে আমরা বিরোধী দলের নেতার সরকারী ভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি। জাহানারা ইমাম বললেন, সরকার যেভাবে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে গণআদালত কীভাবে হবে? এ বিষয়ে আমাদের চেয়ে বেশি জানতেন শেখ হাসিনা। তিনি জাহানারা ইমামের কাছে জানতে চাইলেন ‘গণআদালতে আপনারা কত মানুষ আশা করছেন?’ জাহানারা ইমাম বললেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসবে, আমরা চার থেকে পাঁচ লাখ জনসমাগম আশা করছি।’ আমাদের সামনেই শেখ হাসিনা বিভিন্ন স্থানে ফোন করে লোক সমাগমের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

জনসমাগমের বিষয়ে আশ্বস্ত হয়ে জাহানারা ইমাম বললেন, সরকার যে বলছে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে, একজন মানুষও যদি নিহত হয় তার দায়িত্ব আমি কীভাবে নেব? শেখ হাসিনা বললেন, কোনও লাশ পড়বে না। যদি পড়ে সেটা আমি দেখব। শেখ হাসিনার এই আশ্বাস না পেলে বিএনপি সরকারের রক্তচক্ষু ও হুমকি উপেক্ষা করে আমরা গণআদালত করতে পারতাম না। সেদিন শুধু বাংলাদেশের নয়, বিদেশী পত্রিকায়ও বলা হয়েছে- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। পুলিশ মঞ্চ নির্মাণসামগ্রীসহ সমস্ত মাইক খুলে নিয়ে গিয়েছিল। এর ক্ষতিপূরণও শেখ হাসিনাই করেছিলেন।
নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গণআদালত আয়োজনের জন্য সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেছিল। শেখ হাসিনা এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ১৬ এপ্রিল (১৯৯২) জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা গণআদালতের যৌক্তিকতার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এবং ২৪ জনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা প্রত্যাহার দাবি করে যে মর্মস্পর্শী ভাষণ দিয়েছিলেন আমার বহু লেখায় এর উল্লেখ করে বলেছি- শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ এটি।

তাঁর এই ভাষণের সময় বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে যা কখনও ঘটেনি- সরকারী দলের অনেক সদস্য টেবিল চাপড়ে বিরোধী দলের নেতাকে সমর্থন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন বিএনপির সহসভাপতি ফরিদা হাসান, যাঁর স্বামী বিশিষ্ট শিল্পপতি সাইদুল হাসানকে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। শেখ হাসিনার ভাষণ শেষ হওয়ার পর ফরিদা হাসান তাঁর আসন থেকে নেমে এসে বিরোধী দলের নেতাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
জাহানারা ইমামের আন্দোলনের তিন দশকে শেখ হাসিনা মাত্র তিনবার আমাদের সমাবেশে এসেছিলেন। প্রথমবার তিনি এসেছিলেন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ’৯২-এর ৩ মার্চ জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রথম সমাবেশে। অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি।  দ্বিতীয়বার তিনি আমাদের মঞ্চে এসেছিলেন ’৯২-এর ১৪ অক্টোবর। শেষবার এসেছিলেন ১৯৯৮ সালের ২৭ মার্চ নির্মূল কমিটির ৭ দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ মেলা উদ্বোধনের জন্য। তখন তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনের পর গোটা মেলা ঘুরে দেখেছেন, নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন।

×