
বঙ্গবন্ধুর নারী ও শিশু উন্নয়ন
আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে যখন ফিরে দেখি, তখন তাঁর চিন্তা-চেতনায় ক্রমশ বাঙালীর স্বার্থ ও কল্যাণ-আকাক্সক্ষা কিভাবে পরিণত, পুষ্ট ও বিবর্তিত হচ্ছিল, তখন বিস্ময়বোধ করি তাঁর বাঙালী জাতির প্রধান নেতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া লক্ষ্য করে। সে সময়ে, ’৫০, ৬০-এর দশকে বিঘ্ন-সঙ্কটপূর্ণ বাঙালী জাতির ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে ওঠার যাত্রাপথে তাঁর চিন্তা-চেতনা জেল-জুলুমের মধ্যেও বিবর্তিত হয়ে তিনি পাকি সরকারের কাছেও চিন্তার সমন্বিত রূপ- ছয় দফা দাবি উত্থাপন করলেন। একই সঙ্গে বাঙালীর না পাওয়ার তালিকাকে বাঙালীর কাছে সুস্পষ্ট রূপে উপস্থাপন করেন।
সরকারকেও জানালেন- তারা কি কি ক্ষেত্রে বাঙালীকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। আবার সেই সঙ্গে বাঙালীর বঞ্চনার ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে বাঙালী জাতিকে সচেতন ও সতর্ক করেছেন। পাকিস্তানী সেনা সরকারকে তিনি হুঁশিয়ার করেছেন- ‘যদি আমার মানুষের ওপর আর একটিও গুলি চলে...’ বলে সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার অতি প্রাসঙ্গিক দাবিও জানান। তাঁর জানা ছিল, সামরিক সরকার গোপনে বাঙালী জাতিকে উচিত শিক্ষা দিতে সামরিক হামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এ সঠিক সময়ে তাঁর ছয় দফা দাবিকে এক দফা- স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত করলেন।
সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন করে পুরো দেশকে অচল করে দিলেন। বাঙালী জাতিকে নির্দেশ দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, এবং ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি... তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকো।’ মাতৃভূমিকে সেদিন শত্রুমুক্ত করতে আদেশ দিলেন। তাঁর নির্দেশে-আদেশে তাঁর প্রিয় ‘আমার মানুষ’ বাঙালী নারী-পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি সংগ্রামে।
এখানে আমরা লক্ষ্য করি- বঙ্গবন্ধুর আহ্বান, নতুন নতুন নির্দেশ শোনা, জানা এবং নারীরাও যে বাঙালী জাতির সবরকম আন্দোলন-সংগ্রামের বাইরে থাকবে না- তার প্রমাণ হিসেবে ঢাকার রাজপথে মিছিলে, জমায়েতে নারীদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। পাশাপাশি জেলায় জেলায় নারীরা প্রধানত মহিলা পরিষদের নেতৃত্বে বাঙালীর স্বায়ত্তশাসন এবং পরে বাঙালীর স্বাধীনতার লড়াই শুরুর দাবিতে মিছিল-সভা-সমাবেশ করেছে।
‘৭১-এ যুদ্ধ শুরুর সময় থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত বাঙালী তরুণদের পাশে বাঙালী তরুণীরা নানাভাবে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছে। স্মর্তব্য, বাঙালী জাতি এবং বাঙালীর মহানায়ক বাঙালী নারীদের ওপর পাকিস্তানী সেনাদের অমানুষিক নির্যাতনের বিষয়টি ’৭২-এ মুক্ত স্বদেশে ফিরে তাঁর প্রথম ভাষণে উল্লেখ করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বাঙালী নারীর প্রতি অকথ্য নির্যাতন এবং তার পরবর্তী অবস্থা- সমাজে নিগৃহীতা-ধর্ষিতা এবং অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ ও সদ্যসন্তান প্রসবকারী নারীদের দুরবস্থা দূর করতে তাঁর দ্রুততার সঙ্গে সচেতন ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ গ্রহণ অন্যান্য কর্মকা-ের ভিড়ে প্রায় অনুল্লেখ থেকে যায়।
আমরা লক্ষ্য করি, স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও কর্মযজ্ঞে প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছিল- ১) নির্যাতিতা নারীদের সমাজে পুনর্বাসন এবং ২) সদ্য ভূমিষ্ঠ নির্যাতিতা নারীদের শিশুদের পুনর্বাসন, যাদেরকে হিন্দু মুসলিম কোন পরিবারে গ্রহণ করা ছিল কষ্টসাধ্য বা অসম্ভব।
সে সময়ের গোঁড়া বাঙালী হিন্দু-মুসলিম পরিবারে ও সমাজে বলপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া এবং খান সেনা কর্তৃক ধর্ষিতা নারীদের পরিবার গ্রহণ করছে না- এ ঘটনা দেখে ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু শুধু জাতির জনক নয়, নারীদেরও পিতা হলেন। বললেন- যদি কোথাও তোমাদের পিতার নাম লিখতে হয়, তাহলে পিতার নাম লিখবে- শেখ মুজিবর রহমান। বঙ্গবন্ধুই এই নির্যাতিতা নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ নামকরণ করে তাদের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন ইতিহাসে।
’৭২ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বিদেশী চিকিৎসকদের সহায়তায় হাজার হাজার তরুণীর এ্যাবোরশন করে ঐ তরুণীদের সামাজিক-পারিবারিক সমস্যা থেকে রক্ষা করেছিলেন। এরপর তাঁর অনন্য সাধারণ উদ্যোগটির বিষয় স্মরণ করে বিস্মিত না হয়ে পারি না- তার ক্ষিপ্র, তীক্ষè, দূরদৃষ্টির কথা ভেবে। তিনি বিদেশে অর্থাৎ পশ্চিমা দেশে যেখানে শিশু দত্তক গ্রহণ খুবই সাধারণ ও গ্রহণযোগ্য রীতি, তাদের সরকারকে নির্যাতিতা বাঙালী নারীদের সদ্য ভূমিষ্ঠ এবং কয়েক মাসের শিশুদের দত্তক গ্রহণের আহ্বান জানান। শিশু দত্তক গ্রহণ একটি অতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষত, যখন শিশু ও শিশুদের মায়েরা যুদ্ধজনিত কারণে শত্রু সৈন্য দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার ফল ভোগ করছে, যাতে কোনভাবেই তাদের কোন রকম ভূমিকা নেই।
শিশু সন্তানের ভার নিয়ে অবিবাহিতা বাঙালী তরুণীদের বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার এই মহৎ মানবিক প্রয়াসটি শুধু অভিনব ও বুদ্ধিদীপ্ত নয়, এ পদক্ষেপ শিশু ও শিশুর অবিবাহিতা মাকে বিশাল সুরক্ষা প্রদান করেছে।
আমরা জানি, ইউরোপের অনেক দেশের দম্পতি সে সময় এই যুদ্ধশিশুদের দত্তক গ্রহণ করেছিল। পনেরো জন সদ্য ভূমিষ্ঠ যুদ্ধশিশুকে কানাডা সরকারের উদ্যোগে পনেরোটি কানাডীয় দম্পতির দত্তক গ্রহণের ওপর কানাডা- প্রবাসী একজন বাঙালী গবেষকের গবেষণাজাত বই থেকে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাই। ‘যুদ্ধশিশু’ নামের এই গবেষণা গ্রন্থটিই যুদ্ধশিশুদের ওপর রচিত সম্ভবত একমাত্র গ্রন্থ। অথচ অনেক ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি হতে পারত এই পঞ্চাশ বছর বয়সী যুদ্ধশিশুদের কেন্দ্র করে, যা এখনও হয়নি বলে আফসোস হয়। বইটিতে এই নবজাতকদের বিমানে তোলার আগের একটি ফটো সংযুক্ত আছে। বইটি এখন খুঁজে পেলাম না। সে কারণে গবেষকের নামটি উল্লেখ করতে পারলাম না।
তবে বইটিতে দত্তক গ্রহীতাদের নাম ও পরিচয় আছে। তারা সবাই বিমানটি পৌঁছানোর আগে থেকে কিভাবে উদ্্গ্রীব হয়ে শিশুদের অপেক্ষায় ছিল, তার সুন্দর বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এদের মধ্যে একটি কন্যাশিশু তার জন্মদাত্রী মাকে দেখতে না পাওয়ায় মানসিক সমস্যায়ও ভুগেছে। দত্তক গ্রহীতা পরিবারের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও কিশোরীটি একদিন আত্মহত্যা করে! অন্য চৌদ্দজন যুদ্ধশিশু ভাল, সচ্ছল, যতœবান, বাবা-মায়ের অন্য সন্তানদের সঙ্গে বৈষম্যহীনভাবে বেড়ে উঠলেও তাদের নিজস্ব মনোকষ্ট, অনাকাক্সিক্ষত জন্মের প্রভাব কতটা মর্মান্তিক হতে পারে- তার উদাহরণ এই কিশোরীটি। তবু, সবার ওপরে নবজাতক যুদ্ধশিশু ও তাদের নিরপরাধ তরুণী মায়েদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু বিদেশে নবজাতকদের দত্তক গ্রহণের পদক্ষেপটির চিন্তা করেছিলেন, যা আর কোন রাজনৈতিক নেতার ধারণায় আসত কিনা সন্দেহ। বঙ্গবন্ধুর সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার এটি একটি অনন্য উদাহরণ।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পদক্ষেপ- নির্যাতিতা নারীদের পুনর্বাসন। পরিবারে আশ্রয় না পাওয়া তরুণীদের পুনর্বাসন করার চিন্তাটি গুরুত্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কাছে বিবেচিত হয়েছিল। এই তরুণীদের সমাজে সক্ষম নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের সেলাই-সূচীকর্মকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু দক্ষতা শেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু সরকার। অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমসহ অনেক উচ্চ শিক্ষিতা নারী এ কাজে এগিয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও। তিনি প্রায় প্রতিদিন সেগুনবাগিচায় স্থাপিত এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে নারীদের সাহস ও সমর্থন জোগাতেন।
অনেকের বিয়ের ব্যবস্থাও করেন। সেই ’৭২ সালে নারীদের জন্য সূচীকর্মের বাইরে আর কি কি দক্ষতা সেখানে হতো, অন্য দক্ষতা শেখানো সম্ভব ছিল কিনা, তা আজ স্পষ্টভাবে জানা যায় না। সদ্য স্বাধীন দেশে নারীরা, আমাদের মায়েরা সূচীকর্মই প্রধানত করতেন। তাই সূচীকর্মই প্রধানত শেখার বিষয় ছিল। পরে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন এবং এর সঙ্গে নারীদের হাতে তৈরি নক্সীকাঁথা-পোশাক ইত্যাদি বিক্রির কেন্দ্রটি স্থাপনও সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনায় ছিল। পরে মহিলার সঙ্গে শিশুকে যুক্ত করা হয় এবং মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। আজকের ‘ছোটমনি নিবাস’ পরিত্যক্ত শিশু ও বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণকারী তরুণীদের আশ্রয়স্থল হয়েছে, যা বঙ্গবন্ধুর সেই শিশু ও নারী পুনর্বাসন পরিকল্পনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
জানি না, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট দেশকে যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে উন্নয়নের দিকে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে নিচ্ছিলেন, সে অবস্থায় বাঙালী জাতির শত্রুরা তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার পর পুনর্বাসনের প্রক্রিয়ায় যে নারীরা যুক্ত হয়েছিল, তাদের কি অবস্থা হয়েছিল! এটা জানি, জাতির কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর শুরু করা সব প্রকল্প জিয়া সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল।
অনেক পরে নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা- কয়েকজন বীরাঙ্গনা নির্যাতিতা নারীর জীবন কথা- ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ প্রকাশিত হলে জাতি এই নির্যাতিতা নারীদের বিষয়ে নতুন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে। আজ নির্যাতিতা নারীদের মুক্তিযোদ্ধা নামে অভিহিত করা হচ্ছে এবং তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করছেন। এই অগ্রগতি সূচনায় বঙ্গবন্ধুর নারী-শিশুবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি ও পদক্ষেপের ফল, এতে কোন সন্দেহ নেই।
অবশ্য যেখানে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, পরিচয় পর্যন্ত মুছে দেয়া হয়েছিল, সেখানে নারী ও শিশু কল্যাণ এবং পুনর্বাসন কতটা অস্তিত্ব বজায় রাখবে, সে সন্দেহ থেকেই যায়। বন্ধুবন্ধু যে শিশুদের খুবই ভালবাসতেন, সে কথা সর্বজনবিদিত। আমার মনে হয়, তাঁর শিশুবান্ধব মনটি যুদ্ধের ফল- পিতৃ-পরিচয়হীন শিশুদের সর্বোচ্চ কল্যাণ চিন্তা থেকেই বিদেশী দম্পতিদের কাছে এই শিশুগুলোকে দত্তক প্রদানের অভিনব চিন্তাটি তাঁর মনে উদয় হয়েছিল।
আমাদের মনে হয়, পঞ্চাশ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে কানাডার যে দম্পতিরা পনেরোটি যুদ্ধশিশুর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তাদেরকে একটি কৃতজ্ঞতা-স্মারক দিলে খুব ভাল হয়। এ সঙ্গে ঐ যুদ্ধশিশুদের তাদের মায়েদের দেশটি দেখতে আসার আমন্ত্রণ জানানো হলে তাদের প্রতি জাতির ভালবাসার প্রদর্শন এবং তাদেরকে স্মরণ করাও হবে। সরকার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে।
লেখক : শিক্ষাবিদ