ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

বাঙালী জাতির প্রেরণার উৎস

প্রকাশিত: ২১:১৮, ৩ মার্চ ২০২২

বাঙালী জাতির প্রেরণার উৎস

অগ্নিঝরা মার্চ বাঙালী জাতির জীবনে নানা কারণে অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস। এ মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগে তিনি পাকিস্তানী শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব- ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ১৯৭১ এর ৭ মার্চ সাবেক রেসকোর্স ময়দানে দেয়া এই ঐতিহাসিক ভাষণের সময় মুহুর্মুহু গর্জনে উত্তাল ছিল জনসমুদ্র। লাখো কণ্ঠের একই আওয়াজ উচ্চারিত হতে থাকে দেশের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। মাত্র ১৯ মিনিটের এই একটি ভাষণ জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যে আগুন জ্বলে উঠছেলি সে আগুন ছড়িয়ে পরে বাংলার সর্বত্র। এর পরে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে একাত্তরের মার্চ বাঙালীর জীবনে নিয়ে আসে নতুন বার্তা। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রেফতার করে তার বাড়ি থেকে। পাকিস্তানীরা বাঙালীর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে ২৫ মার্চের কালরাতে অপারশেন সার্চলাইট নামে বাঙালী নিধনে নামে। ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে সৈন্যরা নির্বিচারে হাজার হাজার লোককে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ প্রতিরোধের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়। আবালবৃদ্ধবনিতা যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে জাতি লাভ করে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে সভা সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাঙালীদের যে করতে হবে তাও তাঁর দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল বহু আগে। ৭ মার্চের ভাষণে সেই দিকনির্দেশনাও স্পষ্ট। ভাষণে তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ পাকিস্তানী শাসকদের উদ্দেশে ভাষণে উচ্চারিত হলো সাবধানবাণী, ‘আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’ আবার দেশের সংগ্রামী জনতাকে সাবধান করতেও ভোলেননি তিনি, ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে।’ দিলেন জনযুদ্ধের ডাক, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লা।’ আর এর পরই তাঁর সেই অমোঘ উচ্চারণ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেন ঘোষণা হয়ে গেল সেদিনই। সারা দেশের মানুষ পেয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। মার্কিন সাময়িকী নিউজ উইকের ভাষায়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির ‘কবি’। সে ক্ষেত্রে ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। একই সঙ্গে এই ভাষণে তিনি যে দায়িত্ব সচেতনতা ও ধীশক্তির পরিচয় রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। তাই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালী জাতির অস্তিত্বের মতোই সত্য হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যেই পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যে ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি, সেটা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আগেই। বুঝে গিয়েছিলেন যে জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধ আসন্ন। আর সে যুদ্ধে তিনি উপস্থিত না-ও থাকতে পারেন, আবার গ্রেফতার করা হতে পারে তাঁকে, এটাও যেন তাঁর কাছে স্পষ্ট ছিল। বোধহয় সে কারণেই তিনি স্পষ্ট করে বলে দেন, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অজেয় বজ্রকণ্ঠ আজও কাঁপন ধরায় বাঙালীর রক্তে। আলোড়ন তোলা সেই আহ্বানের জন্যই যেন বাঙালী জাতি অধীর অপেক্ষায় ছিল। বিদ্যুত বেগে সেই আহ্বান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির জনক। তিনি আমাদের প্রেরণার উৎস। আমাদের সত্তায় মিশে আছেন তিনি, থাকবেন। সব ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার মন্ত্রণা দেবে তাঁর ৭ মার্চের বক্তৃতা। লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই
×