ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরীদের জন্য জান্নাত অবধারিত

প্রকাশিত: ২১:২৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরীদের জন্য জান্নাত অবধারিত

ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু সেই শান্তি সব সময় প্রীতির মাধ্যমে আসে না। মানুষের মধ্যে একদল আছে যারা পৃথিবীতে অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন ও নিগ্রহের মাধ্যমে অনবরত অশান্তি সৃষ্টি করে। এসব দুষ্ট মানুষ কখনও পরদেশ, পররাজ্য পরসম্পত্তি দখল বা লুণ্ঠনের মাধ্যমে নিজেদের লোভ লালসা চরিতার্থ করে। এরা কমজোর মানুষের ওপর শক্তির দাপট দেখায়, ধার্মিককে পরিহাস করে এবং দরিদ্রকে লাঞ্ছিত করে। এদের হাত থেকে মনুষ্যত্বকে ও মানুষকে রক্ষা করার এবং শান্তি স্থাপনের জন্য ইসলাম সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা বোধ করে। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা, সুখ ও সমৃদ্ধি মূলত একটি সুশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল, সুসংবদ্ধ, সৎ ও শক্তিশালী, সেনাবহিনীর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সুতরাং সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। পবিত্র কুরআন ও হাদিস গ্রন্থে একজন সাধারণ সৈনিক থেকে আরম্ভ করে সর্বাধিনায়ক পর্যন্ত সকল শ্রেণীর সৈনিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ যথাযথভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন : দুটি চোখ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। একটি হলো ওই চোখ যা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে আর অপরটি হলো যা সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে।-(তিরমিজি ৪/১৭৫)। অন্য হাদিসে নবীজি (সা) বলেন : রাষ্ট্রের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরীদের জন্য জান্নাত অবধারিত। - (আবু দাউদ ৩/৯)। মুসলিম সৈনিকের প্রধান গুণ ‘ইমান’। তিনি আল্লাহ, রাসূল ও পরকালে বিশ্বাসী। আল্লাহ ও রাসূলের (সা) সন্তুষ্টি বিধানই তার জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য। আখিরাত বা পরকালের সুখ শান্তিই তার কাম্য। এ নশ্বর জগতে সে আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টি বিধান এবং পরকালের সুখ-শান্তি লাভের আশায় সে স্বদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, অন্যায় অসত্যের বিলুপ্তি, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এবং শান্তি স্থাপনের জন্য সে নিজের মূল্যবান সময়, সম্পদ এমনকি জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়ে থাকেন। মুসলিম সৈনিক ইমান বা তাওহীদের বলে বলীয়ান। আল্লাহই তার সকল শক্তির উৎস। ইমানদার সৈনিক ব্যক্তি সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দারিদ্র্য-ঐশ্বর্য, সফলতা-বিফলতা সর্বাবস্থায় থাকবে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থাবান। মাথায় বিপদের পাহাড় ভেঙ্গে পড়লেও সে বিচলিত হবে না। এটাকে আল্লাহর কঠোর পরীক্ষা জ্ঞান করে ধৈর্যের পরিচয় দেবে। সুখ-শান্তি বা মান সম্মানের প্রাচুর্যে তিনি হবেন আল্লাহর প্রতি পরম কৃতজ্ঞ। সৎ কর্মশীল ইমানদাররা বড়ই ভাগ্যবান। এ কর্মকোলাহলময় ক্ষণস্থায়ী জীবনের অবসানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে অমর জগতের পরম সুখ ও শান্তি, অপূর্ব নেয়ামত। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসী কাফেররা বড়ই দুর্ভাগ্যবান। পার্থিব জগতে তারা যতই সুখ-শান্তি বা ধন-ঐশ্বর্যের অধিকারী হোক না কেন, তাদের পারলৌকিক জীবন ঘোর অন্ধকারময়। যুদ্ধক্ষেত্রের সাফল্য প্রধানত সৈনিকদের মনোবল বা সঙ্কল্পের ওপর নির্ভরশীল। মনোবল বা সঙ্কল্প যত সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হবে সৈনিকের শক্তি সাহস, শৌর্য-বীর্য ও বীরত্বের পরিধিও তত বিস্তৃত হবে। সুতরাং সৈনিকগণ নিজেদের মহান পেশার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য এবং আল্লাহর পক্ষ হতে এর বিনিময়ে লাভের কথা স্মরণ করে নিজেদের সঙ্কল্প বা মনোবলকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করবে। সৈনিকদের মনোবল উন্নত করার মানসে পবিত্র কুরআন ও হাদিস গ্রন্থে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম, তথা জিহাদের ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। ইমানদার মুসলিম সৈনিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশিকা : অঙ্গীকার বা প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা সততা ও সত্যবাদিতারই এক বাস্তব দিক। আর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা মিথ্যা বা মিথ্যাবাদিতারই নামান্তর। অতএব আল্লাহ, রাসূল (সা) ও পরকালে বিশ্বাসী ইমানদার সৈনিকরা প্রশিক্ষণ শেষে দেশ রক্ষার মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালাকে সাক্ষী রেখে যে অঙ্গীকার বা ‘শপথ বাক্য’ পাঠ করে থাকে তাকে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অঙ্গীকার ভঙ্গ করে কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করা যাবে না। কারণ এর পরিণতি অত্যন্ত মারাত্মক ও ভয়াবহ। মহানবী (সা) বলেছেন, যার মধ্যে আমানত বা বিশ্বস্ততার গুণ নেই তার ইমান নেই। আর যে প্রতিজ্ঞা পালন করে না তার ধর্ম নেই। উর্ধতন কর্মকর্তা বা অধিকর্তাদের প্রতি অধীনস্থ সৈনিকদের আন্তরিক ভক্তি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রদর্শন: উর্ধতন কর্মকর্তা বা অধিকর্তাদের প্রতি অধীনস্থ সৈনিকদের মতের বিপরীত হলেও আল্লাহ ও রাসূলের আদেশের পরিপন্থী না হওয়া পর্যন্ত তাদের আদেশ-নিষেধ অম্লান বদনে মেনে চলবে। কোন রূপ অবাধ্য হওয়া যাবে না। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেছেন, নাক, কান কাটা নিগ্রো ক্রীতদাসকেও যদি তোমাদের নেতা বা কর্মকর্তা ও অধিকর্তা নিযুক্ত করা হয়, যে তোমাদের আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালনা করে, তবে অবশ্য অবশ্য তার আনুগত্য অনুসরণ করবে।’ অধীনস্থ সৈনিকদের প্রতি উর্ধতন কর্মকর্তাগণ আন্তরিক স্নেহ, দয়া-মায়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করবেন। তাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা ও অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে সদা সচেতন থাকবেন। নিজেদের তাদের একজন খাদিম বা দরদী বন্ধু হিসেবে মনে করবেন। মহানবী (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি উপরস্থ জনের প্রতি সম্মাান এবং অধীনস্থ জনের প্রতি স্নেহ ও দয়ামায়া প্রদর্শন করে না, সে আমার যথার্থ উম্মত নয়।-(আল হাদিস) মুসলিম সৈনিকদের একতা ও শৃঙ্খলা বন্ধন : মুসলমান একই ভ্রাতৃসংঘের সভ্য। এতে নর-নারী, উচ্চ-নিচ, ধনী-নির্ধন সকলেরই সমান অধিকার। দেশ, বর্ণ ও বংশ গৌরব ইত্যাদি ভেঙ্গে দিয়ে ইসলাম সকল মুসলমানকে এক সমান করে দিয়েছে। সুতরাং আল্লাহ, রাসূল ও পরকালে বিশ্বাসী ইমানদার সৈনিকগণ অঞ্চল, বংশ, বর্ণ ও ভাষার সব প্রকার ভেদাভেদ বা সঙ্কীর্ণ মনোভাব পরিহার করে একই ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুদৃঢ় ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলবে এবং সামরিক বিধিনিষেধ ও প্রশিক্ষণ অনুযায়ী নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা স্থাপন করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর ঘোষণা : হে ইমানদারগণ তোমরা সকলে একতাবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাক এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। -(৩:১০২)। মহানবী (সা) বলেছেন : মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই। ‘তাকওয়া’ বা ধার্মিকতা ব্যতীত একের ওপর অপরের কোন বিশেষ মর্যাদা নেই। যে মুসলমানের একতা ভঙ্গ করে, সে ইসলামের বাইরে চলে যায়। শারীরিক ও সামরিক শক্তি সঞ্চয় করতে হবে : দুশমনের মনে ভীতি সঞ্চার বা তাদের মোকাবেলা করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শারীরিক ও সামরিক শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। পবিত্র কুরআনে ও হাদিসে শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে তীর চালনা, অশ্ব পালন, সাতার ও অশ্বারোহণের অভ্যাস করার অতিশয় ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। বর্তমান তীর-ধনুক ও অশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বর্তমান গোলাবারুদের যুগে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পরিচালনার অভ্যাস করা এবং শক্তি সাহস ও শৌর্য-বীর্য বর্ধনের উদ্দেশ্যে শারীরিক ব্যায়াম করা বর্ণিত যুদ্ধবিদ্যার আদেশেরই অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্বে দুর্বলের কোন স্থান নেই। শক্তির অস্তিত্ব দর্শনে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুগণ ভীতসন্ত্রস্ত ও শঙ্কিত থাকে। দেশ ও জাতি বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা ও বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সুতরাং যুদ্ধ বাধুক আর নাই বাধুক সর্বাবস্থায় সাধ্যমতো শক্তি সঞ্চয় করে দুশমনের মোকাবেলায় সদা সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে হবে। এটা মহা বিজ্ঞানময়, মহাশক্তিশালী ও পরম কৌশলী আল্লাহর নির্দেশ। সর্বাত্মক ত্যাগের উদ্দীপনায় উদ্দীপিত হয়ে সত্য প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। সুতরাং বর্তমানে অধঃপতন ও দুর্বিষহ অবস্থা দেখে শুধু অশ্রুপাত করলে চলবে না, এর প্রতিকারের পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে। ইসলাম সেই প্রতিকারের পন্থা নির্দেশ করেছে। তাই সামরিক জীবন, যুদ্ধ উন্মত্ত পাগলপারা জীবনধারা। সমগ্র দেশপ্রেমিক সত্যানুসন্ধিৎসু সেই জানমাল ত্যাগী জোশে জেগে উঠুক, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে যুদ্ধক্ষেত্র মনে করে মরদে মুজাহিদের সবক ইখতিয়ার করুক, তবেই তাদের সফলতা ও বিজয় অনিবার্য। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]
×